কানাডা/ইউরোপের প্রলোভন দেখিয়ে নেপালে মানবপাচার: জিম্মি করে অর্থ আদায়, ব্র্যাকের উদ্যোগে ৩ জন উদ্ধার

বাংলাদেশ থেকে নেপালকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে কানাডা, ইউরোপ বা অন্যান্য দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্র বাংলাদেশি তরুণদের ফাঁদে ফেলছে। চক্রটি প্রবাসে পাঠানোর নামে নেপালে নিয়ে তরুণদের জিম্মি করছে এবং নির্যাতন করে পরিবার থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ আদায় করছে। সম্প্রতি এই চক্রের প্রতারণার শিকার তিন বাংলাদেশিকে উদ্ধার করেছে ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম

ব্র্যাকের পক্ষ থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানানো হয়েছে।

প্রতারণার কৌশল ও জিম্মি দশা

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বিদেশগামীদের সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়ে এই প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে বিস্তারিত জানান:

  • লোভনীয় প্রস্তাব: সম্প্রতি সিলেট থেকে এক ব্যক্তির মাধ্যমে ব্র্যাক জানতে পারে যে, তাঁর ভাইসহ তিন জনকে কানাডায় পাঠানোর প্রলোভন দেখানো হয়। প্রলোভন ছিল—কানাডায় পৌঁছানোর পরই সব খরচ পরিশোধ করতে হবে।
  • জিম্মি ও নির্যাতন: গত ১৩ অক্টোবর ওই তিন জনকে নেপালে নেওয়া হয়। সেখানে একটি হোটেলে রেখে চক্রটি পাসপোর্ট ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে অস্ত্রের মুখে তাদের জিম্মি করে রাখে।
  • অর্থ আদায়: চক্রটি জিম্মিদের পাসপোর্টে কানাডার ভিসা ও টিকিট লাগিয়ে সেই ছবি পরিবারকে পাঠায়। এরপর তারা কানাডায় পৌঁছেছে দাবি করে একটি কানাডিয়ান হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্থানীয় দালালকে প্রথমে পাঁচ লাখ টাকা দিতে বলে। পরে প্রত্যেকের কাছে আরও ১২ লাখ টাকা দাবি করা হয়।
  • পরিবারের সন্দেহ: জিম্মিদের অস্ত্রের মুখে ‘আমরা কানাডায় পৌঁছে গিয়েছি, কোম্পানির পক্ষ থেকে ১৫ দিনের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে’—এই কথাগুলো বলতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু একজনের পরিবারের সন্দেহ হলে এবং তারা পরিচিত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেওয়ার শর্তে অর্থ পরিশোধের আশ্বাস দিলেও পাচারকারীরা টালবাহানা শুরু করে ও নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দ্রুত টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেয়।

ব্র্যাকের তৎপরতা ও উদ্ধার অভিযান

  • আইনি পদক্ষেপ: গত ২৬ অক্টোবর পরিবারগুলো ব্র্যাকের সঙ্গে যোগাযোগ করে উদ্ধারের আবেদন জানায়। এরপর ব্র্যাক সিআইডি (অপরাধ তদন্ত বিভাগ) এবং নেপালে যোগাযোগ করে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের কোতোয়ালি থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা রুজু হয়।
  • দালাল গ্রেপ্তার: ওই দিন রাতেই সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ ও সিআইডির যৌথ অভিযানে স্থানীয় একজন দালালকে গ্রেফতার করা হয়।
  • জিম্মিদের মুক্তি: দালাল গ্রেফতারের খবর নেপালের পাচারকারীদের কাছে পৌঁছালে তারা সে দিন রাত ৩টার দিকে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের পাশে ওই তিন জনকে ছেড়ে দেয়। ৩০ অক্টোবর তারা ঢাকায় ফিরলে ব্র্যাকের ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম তাদের সহায়তা করে। পরে গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা তাদের জবানবন্দি নেন।

পাচারকারীদের নেপাল বেছে নেওয়ার কারণ ও সচেতনতা বার্তা

ব্র্যাক জানিয়েছে, শুধু কানাডা নয়, ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে নেওয়ার কথা বলে নেপালে নিয়ে একইভাবে আটকে রেখে অস্ত্র দেখিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে।

  • ভিসা সুবিধা: পাচারকারীরা প্রথমে নেপালকে বেছে নেয়, কারণ নেপালে যেতে বাংলাদেশি নাগরিকদের ভিসা লাগে না এবং অন-অ্যারাইভাল ভিসা পাওয়া যায়।
  • সচেতনতা জরুরি: বিশেষ করে ‘কানাডায় পৌঁছানোর পর টাকা পরিশোধ করা যাবে’ এমন প্রলোভনের ফাঁদে পড়ার বিরুদ্ধে ব্র্যাক সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছে।

ব্র্যাকের পরামর্শ, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাতে হবে। পাশাপাশি বিদেশে বিপদে পড়া যে কেউ ব্র্যাক মাইগ্রেশন ওয়েলফেয়ার সেন্টারে যোগাযোগ করতে পারেন। ব্র্যাক আন্তর্জাতিক ও সরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে তাদের সহায়তা ও পুনর্বাসনে কাজ করবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top