নেক্সপেরিয়া দখল ও চীনের প্রতিশোধ: ইউরোপের শিল্প খাতে শাটডাউনের আশঙ্কা, দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের নতুন মোড়

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বেসিক ট্রানজিস্টর চিপ প্রস্তুতকারক কোম্পানি নেক্সপেরিয়াকে কেন্দ্র করে ইউরোপের শিল্প এবং ভূ-রাজনীতিতে ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। এই চিপ কোম্পানিটি মূলত ইউরোপের বিশাল গাড়ি শিল্প, বিশেষত জার্মানির অটো ইন্ডাস্ট্রির গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা মেটায়। কিন্তু এর মালিকানা চীনের হওয়ায়, নেদারল্যান্ডস হুট করে কোম্পানিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়, যা অনেকে ‘ডাকাতির সমতুল্য’ বলে অভিহিত করেছেন।

দখলের কারণ: আমেরিকান ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ

ডাচ সরকার নেক্সপেরিয়া দখলের কারণ হিসেবে জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু তুলে ধরেছে। তাদের বক্তব্য হলো, এই কোম্পানির মাধ্যমে উন্নত প্রযুক্তি চীনের হাতে চলে যাচ্ছে। তবে এই ঘটনা বিশ্লেষকদের মতে, এটি মূলত আমেরিকার জাতীয় স্বার্থে ইউরোপের একটি পদক্ষেপ। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র একই কায়দায় চীনা কোম্পানি বাইটেড্যান্সের কাছ থেকে টিকটকের মার্কিন ব্যবসার মালিকানা প্রায় জোর করেই কেড়ে নিয়েছিল। জার্মানির হামবুর্গে নেক্সপেরিয়ার বৃহৎ কারখানা থাকা সত্ত্বেও, নেদারল্যান্ডসের এই পদক্ষেপ ইউরোপের অভ্যন্তরে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে।

চীনের পাল্টা আঘাত: সাপ্লাই চেইনে ভয়াবহ সংকট

নেক্সপেরিয়া দখলের মাত্র কয়েক দিনের মাথায় চীন গত ৪ অক্টোবর কোম্পানিটির ওপর রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। নেক্সপেরিয়ার উৎপাদিত বেসিক চিপের অধিকাংশ প্যাকেজিং এবং সাব-অ্যাসেম্বলি অংশ চীন থেকেই আসে। চীনের এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় নেক্সপেরিয়া এবং তাদের সমস্ত চীনা সাব-কন্ট্রাক্টররা পড়েছে। ফলস্বরূপ, কোম্পানিটি আর কোনো চীনা প্যাকেজিং বা সাব-অ্যাসেম্বলি পার্টস পাবে না।

এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) এবং জার্মান অটো ইন্ডাস্ট্রিতে ভয়াবহ এক সাপ্লাই চেইন সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। প্রয়োজনীয় চিপের অভাবে পুরো শিল্পটিই শাটডাউন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর নেদারল্যান্ডস এখন চীনের সঙ্গে আলোচনায় বসে দ্রুত সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে।

দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের চরম পরিণতি

দক্ষিণ কোরিয়ায় সম্ভাব্য ট্রাম্প-শি বৈঠকের ঠিক আগে চীন অত্যন্ত আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে। এই ঘটনাটি স্পষ্টতই চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান ‘দ্বিতীয় স্নায়ু যুদ্ধের’ (টেক-বাণিজ্যিক যুদ্ধ) চরম বহিঃপ্রকাশ।

প্রথম স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মাধ্যমে। কিন্তু বর্তমান দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ, যেখানে বিশ্ব অর্থনীতি প্রযুক্তি ও সাপ্লাই চেইনের মাধ্যমে গভীরভাবে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত, তার পরিণতি কেমন হতে পারে—এটাই এখন বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। নেক্সপেরিয়া সংকট প্রমাণ করে যে, এই টেক-যুদ্ধ শুধুমাত্র নীতি বা নিরাপত্তার বিষয় নয়, এটি সরাসরি বিশ্ব অর্থনীতির গতিপথ নির্ধারণ করছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top