জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টা: আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ও সংস্কার কার্যক্রমের ঘোষণা

বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতির কথা জাতিসংঘকে জানিয়েছেন। শুক্রবার রাতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, নির্বাচনের পাশাপাশি স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

তাঁর ভাষণে তিনি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যা এবং তরুণদের জন্য একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়ার আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরেন। নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় শুক্রবার সকালে এই ভাষণ সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

গণতন্ত্র ও সংস্কারের প্রতিশ্রুতি

জাতিসংঘের এই বৈশ্বিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সরকারকে দেওয়া জনগণের ম্যান্ডেট সম্পর্কে বলেন, ‘ভেঙে পড়া রাষ্ট্রকাঠামোকে পুনর্গঠন করে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের প্রয়োজন ছিল।’ তিনি বলেন, নির্বাহী আদেশে সহজ পথে না গিয়ে তাঁর সরকার একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই পথ বেছে নিয়েছে। এই লক্ষ্যে ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে।

তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ছিল একটি ক্ষমতা-ভারসাম্যপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলা, যেখানে আর কোনো স্বৈরশাসকের আবির্ভাব হবে না।’ তিনি বিশ্বাস করেন যে, গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিলে ‘জুলাই ঘোষণা’র মাধ্যমে যে সময়াবদ্ধ অঙ্গীকার করা হয়েছে, তা আগামী নির্বাচনে যেই সরকারই আসুক না কেন, সংস্কার কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করবে।

অর্থনৈতিক সংস্কার ও পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধার

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের উন্নয়ন কৌশলের কেন্দ্রে সুশাসন ও টেকসই উন্নয়ন রয়েছে। তিনি বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করে বলেন, ‘বিগত দেড় দশকের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, জবাবদিহি ছাড়া যেকোনো উন্নয়ন ক্ষণস্থায়ী ও ভঙ্গুর।’ তাঁর সরকার দায়িত্ব নিয়ে বিগত সরকারের ব্যাপক দুর্নীতি ও জনগণের সম্পদ পাচারের বিষয়টি আবিষ্কার করেছে, যা দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে নাজুক করে ফেলেছিল।

তিনি বলেন, পাচার হওয়া এসব শত শত কোটি ডলারের সম্পদ পুনরুদ্ধার করা বর্তমান সরকারের অন্যতম শীর্ষ অগ্রাধিকার। তবে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আইনি প্রক্রিয়া ও নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার কারণে এই প্রচেষ্টা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি যেসব দেশ ও প্রতিষ্ঠান এসব সম্পদ গচ্ছিত রাখার সুযোগ দিচ্ছে, তাদের অপরাধের শরিক না হওয়ার আহ্বান জানান এবং পাচার হওয়া সম্পদ দ্রুত ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করেন।

মিথ্যা সংবাদ ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আহ্বান

বর্তমানে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা ও ঘৃণাত্মক বক্তব্য যে একটি গুরুতর বৈশ্বিক উদ্বেগ, তা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর থেকে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ্যা সংবাদ ছড়াচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ‘ডিপফেক’ প্রযুক্তি, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। তিনি বলেন, এসব বিকৃত কর্মকাণ্ড যেন মানুষের পারস্পরিক আস্থা ও সামাজিক সম্প্রীতি নষ্ট না করে, তা নিশ্চিত করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

রোহিঙ্গা সংকট ও আঞ্চলিক সংঘাত

মিয়ানমারে চলমান সংঘাতকে সমগ্র অঞ্চলের জন্য গভীর উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এটি শুধু আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাকেই ঝুঁকিতে ফেলছে না, বরং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকেও কঠিন করে তুলেছে। তিনি বলেন, গত আট বছরেও রোহিঙ্গা সংকটের কোনো সমাধান দেখা যায়নি এবং বাংলাদেশ এখনো নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে বাধ্য হচ্ছে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর অধিকারবঞ্চনা ও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য বৈষম্যমূলক নীতির সমাধান এবং রাখাইনের সমস্যার চূড়ান্তভাবে রাজনৈতিক সমাধান করা অপরিহার্য।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top