সদ্যপ্রয়াত বদরুদ্দীন উমরের বিস্ফোরক সাক্ষ্য: ‘শেখ হাসিনা ভারত-নির্ভর হয়ে নির্বাচন ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করেছেন’

সদ্যপ্রয়াত লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন সংস্থার তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া বক্তব্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন। তাঁর সাক্ষ্যমতে, শেখ হাসিনা তাঁর শাসনামলে বড় ধরনের অপরাধ করেছেন এবং তাঁকে এ সময় ভারত সমর্থন দিয়ে গেছে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে তার সাক্ষ্য দেওয়ার কথা থাকলেও, তার আগেই আজ রোববার (৭ সেপ্টেম্বর) সকালে তিনি মারা যান।

প্রসিকিউশন সূত্র জানিয়েছে, ট্রাইব্যুনাল আইনের ১৯(২) ধারা অনুযায়ী, কোনো সাক্ষী তদন্ত কর্মকর্তার কাছে সাক্ষ্য দিয়ে মারা গেলে প্রসিকিউশন তা গ্রহণের জন্য আবেদন করতে পারে।

ক্ষমতা, নির্বাচন ও ভারতের ভূমিকা

তদন্ত কর্মকর্তার কাছে দেওয়া বক্তব্যে বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। তাঁর মতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি নির্বাচন তিনি ম্যানিপুলেট করেছেন। এটি সম্ভব হয়েছে কারণ রাষ্ট্রীয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ওপর, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ এবং আমলাতন্ত্রের ওপর তিনি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

তিনি বলেন, কোনো ধরনের নীতিবোধ বা নৈতিকতা ছাড়াই ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করে তা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলেও, ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসেই তিনি নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে জয়ী হতে পারবেন না বুঝে সেই পদ্ধতি বাতিল করে দেন।

বদরুদ্দীন উমর অভিযোগ করেন, শেখ হাসিনা প্রশাসনকে দুভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছেন—প্রথমত ঘুষ ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, এবং দ্বিতীয়ত হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে। এর মাধ্যমে তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনকে ‘ভোটকেন্দ্রে কাউকে ঢুকতে না দেওয়া’, ২০১৮ সালের ‘রাতের ভোট’ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনকে ‘জনসমর্থন ছাড়া জয়’ নিশ্চিত করেছেন। তাঁর মতে, জনসমর্থন না থাকলেও প্রশাসনের ওপর চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের কারণে তিনি ক্ষমতায় থেকেছেন।

রাজনৈতিক দমন, গুম ও নির্যাতন

সাক্ষ্যে বদরুদ্দীন উমর আরও অভিযোগ করেন যে, শেখ হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালিয়েছেন। বিরোধী দলগুলোকে অকার্যকর করতে নির্যাতন করা হয়েছে এবং প্রচুর মানুষকে বিনা কারণে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়েছে। তাঁর মতে, ‘আয়নাঘর’ নামে গোপন টর্চার সেল তৈরি করা হয়েছিল, যা শেখ মুজিবুর রহমানের আমলেও ছিল না।

তিনি বলেন, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কেবল তারাই করতে পারে যাদের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা রয়েছে এবং গোয়েন্দা বিভাগ, যেমন ডিজিএফআই, তাদের অধীনে থাকে। তিনি অভিযোগ করেন, ‘আয়নাঘর’-এর মতো গোপন নির্যাতন এবং গুমের মতো অপরাধগুলো ডিজিএফআইয়ের মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে, যার উদ্দেশ্য ছিল বিএনপিসহ সমস্ত বিরোধী দলকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা।

ভারতে অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ

শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান প্রসঙ্গে বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, ভারতই একমাত্র রাষ্ট্র যারা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে এবং এ কারণে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সঙ্গে তার গভীর সম্পর্ক ছিল। তিনি বলেন, ‘সে ওখানেই থাকবে। ওখানে থাকাটাই একধরনের শাস্তি—সেখানে সে জ্বলে-পুড়ে মরবে।’ তিনি আরও ভয়ংকর মন্তব্য করে বলেন যে, নিজেদের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে ভারত সরকার তাকে মেরে ফেলতে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top