অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক বছর: স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও বিচার প্রতিষ্ঠায় সাফল্য

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামীকাল শুক্রবার (৮ আগস্ট) এক বছর পূর্ণ করতে যাচ্ছে। গত বছর ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই এক বছরে সরকার নানা প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে দেশ পরিচালনায় বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে এই এক বছরের ১২টি প্রধান সাফল্যের কথা তুলে ধরেছেন।

শান্তি ও স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সরকারের অন্যতম বড় অর্জন। এর ফলে দেশে চলমান নৈরাজ্য ও প্রতিশোধের প্রবণতা বন্ধ হয়েছে। প্রেস সচিবের মতে, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নৈতিক নেতৃত্ব এই স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় মূল ভূমিকা পালন করেছে, যা দেশকে সহিংসতার পরিবর্তে পুনর্মিলন ও গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করেছে।

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও বাণিজ্যিক অগ্রগতি

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে থাকা অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা সরকারের একটি বড় সাফল্য। এই এক বছরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৪% থেকে কমে অর্ধেকে নেমে এসেছে। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিও ৮.৪৮%-এ নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে, যা গত ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এছাড়াও, রেমিট্যান্সে রেকর্ড ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, রপ্তানি ৯% বৃদ্ধি, বহু বছর পর টাকার বিপরীতে ডলারের মান বৃদ্ধি এবং ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে।

বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সফলভাবে শুল্ক আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। অনেক বিশেষজ্ঞ এটিকে কঠিন বলে মনে করলেও, সরকার তা সম্ভব করে দেখিয়েছে। এর পাশাপাশি, হানদা গ্রুপের ২৫ কোটি ডলারের টেক্সটাইল বিনিয়োগসহ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) এসেছে। চীনা বিনিয়োগকারীরাও এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছেন।

গণতান্ত্রিক সংস্কার ও জুলাই সনদ

সরকার একটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে এবং ৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করেছে। ঐতিহাসিক জুলাই সনদ চূড়ান্ত করা হয়েছে, যা প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে এবং ভবিষ্যতে স্বৈরতন্ত্রের পুনরাবৃত্তি রোধে একটি সুরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে কাজ করবে। আশা করা হচ্ছে, এই সনদ দেশে গণতন্ত্রের নতুন যুগের সূচনা করবে।

জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার ও আইনগত সংস্কার

জুলাই ও আগস্টের সহিংসতায় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে, যা দোষীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক হবে। এখন পর্যন্ত চারটি প্রধান বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে, যার মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বিচারও অন্তর্ভুক্ত।

আইনগত সংস্কারের ক্ষেত্রেও সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বিচার বিভাগে সংস্কারের মাধ্যমে এর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুলিশে মানবাধিকার সেল, বডি ক্যামেরা, স্বচ্ছ জিজ্ঞাসাবাদ কক্ষ এবং জাতিসংঘ মানদণ্ডের প্রতিবাদ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিতে পরিবর্তন এনে গ্রেফতারের ১২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবারকে জানানো, আইনজীবী ও চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করা এবং অনলাইনে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে।

নির্বাচন পরিকল্পনা ও প্রবাসীদের অধিকার

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও উৎসবমুখর নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই নির্বাচনে প্রবাসী, নতুন ভোটার এবং নারীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে প্রায় ৮ লাখ পুলিশ, আনসার ও সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।

গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বৈদেশিক নীতি

সরকার দমনমূলক সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইন্টারনেট অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও একদেশভিত্তিক নির্ভরতা থেকে সরে এসে বহুমুখী নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, চিকিৎসা সহায়তা ও সংকট ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, সার্ক পুনরুজ্জীবন এবং আসিয়ান সদস্যপদ অর্জনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top