একসময় যে রোগকে একতরফাভাবে মরণব্যাধি হিসেবে দেখা হতো, সেই ক্যান্সার আজ আর অদম্য নয়। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতি, নতুন নতুন গবেষণা এবং যুগান্তকারী উদ্ভাবন ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে, যা বিশ্বজুড়ে ক্যান্সার রোগীদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চার করছে। এখন আর ক্যান্সার মানেই শেষ নয়, বরং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করলে সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব।
ব্যক্তি-ভিত্তিক চিকিৎসা (Personalized Medicine):
ক্যান্সার চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় অগ্রগতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যক্তি-ভিত্তিক চিকিৎসা বা ‘পার্সোনালাইজড মেডিসিন’। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি রোগীর ক্যান্সারের জেনেটিক মেকআপ এবং আণবিক বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করা হয়। এর ফলে, চিকিৎসকরা এমন থেরাপি বেছে নিতে পারেন যা রোগীর নির্দিষ্ট ধরনের ক্যান্সারের জন্য সবচেয়ে কার্যকর। যেমন, কিছু ক্যান্সার রোগীর টিউমারে নির্দিষ্ট কিছু জিনগত পরিবর্তন থাকে, যার জন্য ‘টার্গেটেড থেরাপি’ অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারে। এটি সুস্থ কোষগুলোর ক্ষতি কমিয়ে আনে এবং চিকিৎসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও কমিয়ে আনে।
ইমিউনোথেরাপি: শরীরের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জাগরণ:
ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইমিউনোথেরাপি একটি বিপ্লবী পরিবর্তন এনেছে। এই চিকিৎসাপদ্ধতি ক্যান্সারের কোষগুলোকে ধ্বংস করার জন্য শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে (ইমিউন সিস্টেম) শক্তিশালী করে তোলে। একসময় ইমিউন সিস্টেম ক্যান্সার কোষগুলোকে ‘শত্রু’ হিসেবে চিনতে পারত না। ইমিউনোথেরাপি শরীরের প্রতিরক্ষা কোষগুলোকে ক্যান্সার কোষ চিনতে ও আক্রমণ করতে সাহায্য করে। মেলাব্লাস্টোমা, ফুসফুসের ক্যান্সার, কিডনি ক্যান্সারসহ অনেক ধরনের ক্যান্সারের চিকিৎসায় এটি অবিশ্বাস্য সাফল্য এনেছে।
প্রোটন থেরাপি: সুনির্দিষ্ট নিশানায় বিকিরণ:
ঐতিহ্যবাহী রেডিয়েশন থেরাপির একটি উন্নত সংস্করণ হলো প্রোটন থেরাপি। এই পদ্ধতিতে ক্যান্সার কোষগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ্য করে প্রোটন রশ্মি প্রয়োগ করা হয়। এর ফলে আশেপাশের সুস্থ কোষগুলোর ক্ষতি হয় না বললেই চলে, যা বিশেষ করে মস্তিষ্ক, চোখ, মেরুদণ্ড এবং শিশুদের ক্যান্সারের চিকিৎসায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম হওয়ায় এটি রোগীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে।
তরল বায়োপসি ও উন্নত স্ক্রিনিং:
ক্যান্সার শনাক্তকরণেও এসেছে আধুনিকতা। ‘লিকুইড বায়োপসি’ বা তরল বায়োপসি একটি নন-ইনভেসিভ পদ্ধতি, যেখানে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যান্সারের কোষ বা ডিএনএ শনাক্ত করা যায়। এর ফলে দ্রুত ক্যান্সার শনাক্ত করা এবং চিকিৎসার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়। এছাড়া, ম্যামোগ্রাম, কোলনোস্কোপি, এবং প্যাপ টেস্টের মতো উন্নত স্ক্রিনিং পদ্ধতিগুলো ক্যান্সারের প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করছে, যখন এটি সবচেয়ে বেশি নিরাময়যোগ্য।
সচেতনতা ও আশার বার্তা:
এইসব আধুনিক চিকিৎসার কারণে ক্যান্সার এখন আর ‘অনিবার্য’ নয়। এর পরিবর্তে, এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী রোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যা সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। প্রতিটি রোগীর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত চিকিৎসা খুঁজে বের করতে চিকিৎসকদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা অপরিহার্য। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধি, এবং প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়—এগুলোই ক্যান্সারকে পরাজিত করার মূল চাবিকাঠি।
ক্যান্সার রোগীদের আশাহত না হয়ে চিকিৎসার নতুন সম্ভাবনাগুলো সম্পর্কে অবগত থাকা উচিত। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান নিরন্তর গবেষণার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন আশার বার্তা নিয়ে আসছে।