প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর ও স্বাধীন পুলিশ কমিশনে ঐকমত্য: ঐকমত্য কমিশন

ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত হয়েছে যে, একজন ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রী পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। এছাড়াও, একটি স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনেও তারা ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। গতকাল রবিবার (২৭ জুলাই) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ১৯তম দিনের আলোচনা শেষে তিনি এই ঘোষণা দেন।

ড. আলী রীয়াজ উল্লেখ করেন, জুলাই সনদে প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ ১০ বছর উল্লেখ করা হবে, এবং এই বিষয়ে সকল অংশগ্রহণকারী দল সম্মতি জানিয়েছে।

এই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এলডিপি, গণ অধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি এবং আমার বাংলাদেশ পার্টিসহ প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান, ড. বদিউল আলম মজুমদার, সফর রাজ হোসেন, ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।

এর আগে সকালে সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদের খসড়া প্রস্তুত হয়েছে এবং আগামীকাল (আজ) সোমবারের মধ্যে এটি সকল রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হবে। দলগুলো দ্রুত তাদের মতামত দিলে সেগুলো সনদে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত মূলনীতি এবং পুলিশ কমিশন গঠন-সংক্রান্ত প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা চলছে।

এদিকে, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) প্রধান উপদেষ্টার জানানো উচিত। তিনি বলেন, “আমরা সবসময় দলের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানিয়েছি লন্ডনে বৈঠকের পর প্রতিশ্রুত এবং সম্মত দিন-তারিখ-মাস, ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে রমজানের আগে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে।” তিনি জোর দিয়ে বলেন যে, যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনকে বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টার জানানো উচিত অথবা তার কার্যালয় থেকে জানানো উচিত। বিএনপির এই নেতা বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন না পাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজেরা যা-ই আলোচনা করি, অথবা প্রধান উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে আলোচনা করুন বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করুন, সেটা নির্বাচন কমিশনের জন্য গুরুত্ববহ হবে না।” তার মতে, নির্বাচন কমিশন তখনই এটিকে নির্দেশনা বা অনুরোধ হিসেবে মেনে নেবে, যখন আনুষ্ঠানিকভাবে সেই যোগাযোগ বা বার্তা যাবে এবং আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অনুরোধপত্র পাবে। সালাহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, “আমরা সেটার জন্য অপেক্ষা করছি। কয়েকজন রাজনীতিবিদ বলেছেন, এটা আগামী ১০ দিনের মধ্যে দেওয়া হতে পারে। কিন্তু সেটা হচ্ছে প্রেসের সঙ্গে রাজনীতিবিদদের কথা। তবে এটা কার্যকর হবে যখন প্রধান উপদেষ্টা আনুষ্ঠানিকভাবে ভাষণ দিয়ে জাতিকে জানাবেন এবং সেটা নির্বাচন কমিশনকে জানাবেন।”

অপরদিকে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন মন্তব্য করেছেন যে, সব দলের সঙ্গে আলোচনা না করে নির্বাচন দিলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, “এর আগে লন্ডনে বসে যখন একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল, আমরা তার প্রতিবাদ করেছি। যদি সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা না করে সরকার নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হয়, সেটা যে গ্রহণযোগ্য হবে না, সেটা বলার অবকাশ রাখে না।”

আখতার হোসেন আরও বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, যারা বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে, এই ফ্যাসিবাদবিরোধী পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই যদি সরকার নির্বাচনের মতো বিষয়কে খোলাসা করতে শুরু করে, এটাকে যদি সুনির্দিষ্ট করতে শুরু করে, তাহলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বিষয়টি আমরা পুনর্বিবেচনা করব।” তিনি মনে করেন, প্রধান উপদেষ্টা ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে—এমন একটা সময়সীমা অনেক আগেই বলেছেন। তার মতে, এই সময়সীমার মধ্যেই বিচার-সংস্কারকে দৃশ্যমান পর্যায়ে উন্নীত করা সম্ভব। একই সঙ্গে জুলাই ঘোষণাপত্র এবং জুলাই সনদ সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার মধ্য দিয়ে বাস্তবায়ন করা সম্ভব। সেই সময়ের মধ্যেই নির্বাচন আয়োজন হতে পারে।

এনসিপির সদস্য সচিব আরও বলেন, “সরকার যদি একটি দলের সঙ্গে আলোচনা করে বা এক দলের সঙ্গে কথাবার্তা বলে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করে, তাহলে বাংলাদেশের বাকি ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তা গ্রহণযোগ্য হবে না।” তিনি বিশ্বাস করেন, নির্বাচনের আগে বিচার-সংস্কারকে দৃশ্যমান পর্যায়ে উন্নীত করা, জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা, নির্বাচনের জন্য মাঠপ্রশাসনের নিরপেক্ষতা এবং একই সঙ্গে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের ঘোষণার দিকে যেতে হবে। তার মতে, অবশ্যই জুলাই সনদ এবং জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের পর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা যেতে পারে।

আখতার হোসেন পরিশেষে বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো যদি দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সামগ্রিক রাষ্ট্রীয় স্বার্থ এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে যায় এমন সুপারিশে আমরা একমত হতে পারি, তাহলে জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি।”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top