২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম: বিচারের দাবিতে উত্তাল শাহবাগ ও শহীদ হাদির শেষ বিদায়

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অকুতোভয় যোদ্ধা এবং ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির অকাল প্রয়াণে শোক ও ক্ষোভে ফেটে পড়েছে সারা দেশ। শনিবার (২০ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানীর শাহবাগ মোড়ে এক বিশাল সমাবেশ থেকে হাদির হত্যাকারীদের গ্রেপ্তারে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার চূড়ান্ত আল্টিমেটাম দিয়েছে ইনকিলাব মঞ্চ। সংগঠনের সদস্য সচিব আবদুল্লাহ আল জাবের অত্যন্ত কঠোর ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, আগামীকাল রোববার বিকেল সোয়া ৫টার মধ্যে যদি খুনিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি বা সুনির্দিষ্ট জবাব না আসে, তবে ছাত্র-জনতা আবারও শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়ে রাজপথ অচল করে দেবে। দাফন সম্পন্ন হওয়ার পর বিকেলে শাহবাগে হাজার হাজার মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত জমায়েত প্রমাণ করেছে যে, হাদির শাহাদাত আধিপত্যবাদবিরোধী চেতনাকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিকেলের এই উত্তাল প্রতিবাদের আগে আজ দুপুরে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় শহীদ শরীফ ওসমান হাদির প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা এবং লাখো সাধারণ মানুষ অংশ নেন। জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বিকেল ৩টা ১৮ মিনিটে তাঁর মরদেহ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশে নিয়ে আসা হয় এবং বিকেল ৩টা ৪৮ মিনিটে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হয়। কবির পাশে এই অকুতোভয় সেনানীকে চিরনিদ্রায় শায়িত করার মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের একটি দাবি পূরণ হয়েছে। দাফন শেষ হওয়ার পরপরই শাহবাগ এলাকায় প্রতিবাদী জনতার ভিড় আরও বাড়তে থাকে এবং বিকেলের দিকে তা এক বিশাল মহাসমাবেশে রূপ নেয়, যার ফলে রাজধানীর ওই এলাকার যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।

সমাবেশ থেকে কেবল বিচারই নয়, বরং শাহবাগ মোড়ের নাম পরিবর্তন করে ‘হাদি চত্বর’ করার জোরালো দাবি জানানো হয়েছে। আন্দোলনকারীরা মনে করেন, হাদির আত্মত্যাগ ও সংগ্রামী আদর্শকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে শাহবাগের এই মোড়টি তাঁর নামেই উৎসর্গ করা উচিত। আবদুল্লাহ আল জাবের তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট করে বলেন, হাদি কেবল একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন সার্বভৌমত্ব ও ইনসাফের কণ্ঠস্বর। তাঁর খুনিদের আড়াল করার কোনো চেষ্টা এ দেশের ছাত্র-জনতা মেনে নেবে না। সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা পর্যন্ত শাহবাগে এই টানটান উত্তেজনা বিরাজ করলেও পরবর্তীতে আন্দোলনকারীরা আজকের মতো রাস্তা ছেড়ে দেন, তবে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম অতিক্রান্ত হওয়ার পর কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি বহাল রাখেন।

শরীফ ওসমান হাদির এই বিয়োগান্তক অধ্যায় শুরু হয়েছিল গত ১২ ডিসেম্বর বিজয়নগর এলাকায়। সেই অভিশপ্ত দুপুরে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে দুর্বৃত্তরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে একটি বুলেট তাঁর মস্তিষ্কে বিঁধে যায়। অত্যন্ত আশঙ্কাজনক অবস্থায় প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসা চললেও শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। পরবর্তীতে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজনে গত ১৫ ডিসেম্বর তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। টানা কয়েক দিন জীবন ও মৃত্যুর লড়াই চালিয়ে অবশেষে ১৮ ডিসেম্বর রাতে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁর মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। হাদির এই বিদায়ে দেশজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে এবং বিচার না পাওয়া পর্যন্ত রাজপথের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ নিয়েছেন সাধারণ মানুষ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top