বিদ্রোহী কবির পাশে চিরনিদ্রায় শরিফ ওসমান হাদি: লাখো মানুষের অশ্রুসিক্ত বিদায়

শনিবার বিকেলে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সম্পন্ন হলো জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অকুতোভয় সেনানী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির শেষ বিদায়। বিকেল ঠিক ৪টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ সংলগ্ন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সমাধির পাশেই তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। মা যেমন তাঁর সন্তানকে পরম মমতায় আগলে রাখেন, তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার এই কৃতী সন্তানকে আজ নিজের বুকে টেনে নিয়েছে। দাফনের সময় হাদির সহকর্মীরা কান্নায় ভেঙে পড়লেও তাঁদের কণ্ঠে ছিল প্রতিরোধের দৃঢ় শপথ—তাঁরা জানিয়েছেন, হাদির যে অসম্পূর্ণ স্বপ্ন ছিল, তা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের লড়াই রাজপথে অব্যাহত থাকবে। সমবেত জনতা ও সহযোদ্ধাদের কণ্ঠে আজ একটি কথাই বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল যে, জীবিত হাদির চেয়ে ‘শহীদ হাদি’ আজ বহুগুণ বেশি শক্তিশালী ও অনুপ্রেরণার উৎস।

হাদির এই অন্তিম বিদায়ে অংশ নিয়ে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান গভীর আবেগঘন বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি জানান, আজ তিনি কোনো রাজনৈতিক প্রটোকল বা উচ্চপদস্থ সাক্ষাতের চেয়ে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে হাদির জানাজায় শামিল হওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনকি প্রধান উপদেষ্টার ডাক পাওয়া সত্ত্বেও তিনি হাদির বিদায়বেলায় তাঁর পাশে থাকাকেই শ্রেয় মনে করেছেন। মাহমুদুর রহমানের মতে, হাদিকে মহান আল্লাহ ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তৃতীয় শহীদ হিসেবে কবুল করে নিয়েছেন। একই সুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমদ খান বলেন, শরিফ ওসমান হাদি আজ থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তিনি হাদির পরিবারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ধিত পরিবারের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করে জানান, জাতীয় কবির পাশে তাঁকে সমাহিত করার সিদ্ধান্তটি ছিল হাদির ত্যাগের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মানের বহিঃপ্রকাশ।

এর আগে রাজধানী ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে হাদির প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ইমামতি করেন তাঁর বড় ভাই আবু বকর সিদ্দিক। জানাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা এবং লাখো সাধারণ মানুষের ঢল নামে। জানাজা শেষে কফিনবাহী অ্যাম্বুলেন্সটিকে ঘিরে এক বিশাল শোক মিছিল বের করা হয়, যা নগরীর বিভিন্ন পথ প্রদক্ষিণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছায়। দাফন শেষে হাদির বড় ভাই উপস্থিত সকলের উপস্থিতিতে দোয়া পরিচালনা করেন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, হাসনাত আব্দুল্লাহসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ।

শরিফ ওসমান হাদির এই ট্র্যাজিক অধ্যায়টি শুরু হয়েছিল গত ১২ ডিসেম্বর। সেই দুপুরে বিজয়নগর এলাকায় নির্বাচনি প্রচারণার সময় চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে একটি বুলেট তাঁর মাথায় বিদ্ধ হয়। সংকটজনক অবস্থায় তাঁকে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং পরে এভারকেয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছিল। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে উন্নত চিকিৎসার আশায় তাঁকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে দীর্ঘ লড়াই শেষে ১৮ ডিসেম্বর রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় তাঁর মরদেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। হাদির এই আত্মত্যাগ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে এক নতুন গতির সঞ্চার করেছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top