ভারতকে বাদ দিয়ে নতুন আঞ্চলিক জোটের প্রস্তাব পাকিস্তানের: বাংলাদেশ, চীনসহ অন্যান্য দেশ অন্তর্ভুক্তির ইঙ্গিত

পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইসহাক দার বাংলাদেশ, চীন ও ইসলামাবাদের মধ্যকার সাম্প্রতিক ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগকে সম্প্রসারিত করার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এই উদ্যোগকে এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ, এমনকি এর বাইরের দেশগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করে একটি বৃহত্তর সহযোগিতামূলক কাঠামোতে রূপান্তর করা যেতে পারে।

গত বুধবার (৪ ডিসেম্বর) ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে তিনি এই মন্তব্য করেন। এই প্রস্তাবটি এমন এক সময়ে এলো, যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার তীব্র উত্তেজনার কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)।

১. পাকিস্তানের প্রস্তাব ও ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের পটভূমি

  • শূন্য-সমষ্টি পদ্ধতির বিরোধিতা: ইসহাক দার বলেন, “আমরা… শূন্য-সমষ্টি পদ্ধতির (এক পক্ষের লাভের জন্য অন্য পক্ষের সমতুল্য ক্ষতি) বিরোধিতা করেছি এবং সংঘর্ষের পরিবর্তে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তার ওপর ধারাবাহিকভাবে জোর দিয়েছি।”

  • নতুন জোটের ইঙ্গিত: এই প্রস্তাবটি মূলত দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন আঞ্চলিক জোট সৃষ্টির ওপর জোর দেয়, যেখানে চীনও অন্তর্ভুক্ত হবে এবং যার লক্ষ্য হবে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

  • বর্তমান ত্রিপক্ষীয় আলোচনা: গত জুন মাসে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নেন। তারা এটিকে এমন একটি সহযোগিতার সম্পর্ক হিসেবে চিহ্নিত করেন, যা কোনো তৃতীয় পক্ষের দিকে (ভারতের দিকে ইঙ্গিত) পরিচালিত হয়নি।

২. আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং উত্তেজনার প্রেক্ষাপট

ইসহাক দারের মন্তব্য ভারত ও পাকিস্তানের কয়েক দশক ধরে চলা প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধির পটভূমিতে এসেছে:

  • ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা: গত মে মাসে দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী চার দিনের বিমানযুদ্ধে লিপ্ত হয়, যা তাদের সম্পর্কে আরও টানাপোড়েন সৃষ্টি করে।

  • বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি: গত বছরের আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর ঢাকা ও নয়াদিল্লির মধ্যে সম্পর্কের তীব্র অবনতি ঘটে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিলেও, হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান এবং নয়াদিল্লি তাঁকে বাংলাদেশে ফেরত দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।

  • জাতীয় উন্নয়ন বনাম জিম্মিদশা: ইসহাক দার বলেন, “আমাদের নিজস্ব জাতীয় উন্নয়নের চাহিদা এবং আঞ্চলিক অগ্রাধিকার কারো কাছে জিম্মি হতে পারে না এবং করা উচিত নয়।” তিনি ভারতের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “আপনি জানেন যে আমি কার কথা বলছি।”

৩. সার্কের অচলাবস্থা ও নতুন জোটের কার্যকারিতা

১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সার্ক মূলত ভারত ও পাকিস্তানের দশকব্যাপী উত্তেজনার কারণে গত ৪০ বছর ধরে তার লক্ষ্য অর্জনে লড়াই করেছে।

  • সার্ক অচল: ২০১৬ সালে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে হামলার কারণ দেখিয়ে ভারত ১৯তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত হয়।

  • ঐক্যমতের অভাব: লাহোর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিএসএসপিআর-এর পরিচালক রাবিয়া আখতার বলেন, সার্কের কাজ করার জন্য ঐক্যমতের প্রয়োজন এবং দুই বৃহত্তম সদস্যের রাজনৈতিক ইচ্ছা ছাড়া এটি এগিয়ে যেতে পারে না।

  • আকাঙ্ক্ষা বনাম বাস্তবতা: আখতারের মতে, পাকিস্তানের এই প্রস্তাব এই পর্যায়ে সম্ভবত ‘কার্যক্ষমতার চেয়ে বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী’। তবে এটি আঞ্চলিক সহযোগিতা ব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় করার পাকিস্তানের ইচ্ছার ইঙ্গিত দেয়।

৪. আঞ্চলিক বাণিজ্যের দুর্বলতা ও সংযোগের গুরুত্ব

বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা ২০০ কোটিরও বেশি হওয়া সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য অত্যন্ত কম—যা এই অঞ্চলের সামগ্রিক বাণিজ্যের মাত্র ৫ শতাংশ (প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার)।

  • বাধা দূরীকরণ: বিশ্বব্যাংকের অনুমান, দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো যদি বাণিজ্য বাধা কমিয়ে আনে, তাহলে তারা ৬৭ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য বিনিময় করতে পারত।

  • সংযোগের অভাব: আঞ্চলিক সংযোগের অভাব দুর্বল বাণিজ্যের একটি প্রধান কারণ। ২০১৪ সালে সার্ক মোটরযান চুক্তি স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত থাকলেও, ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে তা আটকে যায়।

৫. পাকিস্তানের প্রস্তাব কি সফল হবে?

শিক্ষাবিদ আখতার বলেন, এই প্রস্তাবের সফলতা দুটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করবে:

  • প্রথমত, ছোট ও ইস্যুকেন্দ্রিক জোটের কার্যকর মূল্য অন্যান্য সম্ভাব্য রাষ্ট্রগুলো দেখতে পায় কি না।

  • দ্বিতীয়ত, এতে অংশ নিলে রাজনৈতিকভাবে চড়া মূল্য দিতে হয় কি না।

রাবিয়া আখতার বিশ্বাস করেন, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও সম্ভবত ভুটানের মতো দেশগুলো অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা এবং জলবায়ু অভিযোজনের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানমূলক অংশগ্রহণের জন্য উন্মুক্ত থাকতে পারে। তবে ভারতের আঞ্চলিক সংবেদনশীলতার কারণে প্রকৃত সদস্যপদ গ্রহণে সতর্ক থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।

এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের পরিচালক ফারওয়া আমের মনে করেন, পাকিস্তানের প্রস্তাবটি ‘কৌশলগতভাবে সুসংগত’। চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ উপসাগরীয় অঞ্চলের সাথে পাকিস্তানের নবায়নযোগ্য সম্পর্কের কারণে ইসলামাবাদ একটি গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক চালক হিসেবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দেখাচ্ছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top