“ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা ভীষণভাবে নষ্ট হয়েছে”: জুলাই সনদের সুপারিশ নিয়ে প্রশ্ন তুললেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের উপায়-সম্পর্কিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি মন্তব্য করেছেন, কমিশনের কার্যক্রমে ‘ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা ভীষণভাবে নষ্ট হয়েছে’ এবং এই সুপারিশগুলো ‘এলোমেলো, অবাস্তব বিষয়’ দিয়ে ভরা, যা দেশের অস্থিতিশীলতা আরও বাড়িয়ে দেবে।

১. ঐকমত্য ও নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ

বিএনপির পক্ষ থেকে করা অভিযোগ প্রসঙ্গে ড. শাহদীন মালিক বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যে সনদে স্বাক্ষর করেছে, আর চূড়ান্ত দলিলে যদি তার থেকে ‘ফারাক’ থাকে, তবে তা অত্যন্ত গুরুতর অভিযোগ।

“একটা কাগজের কথা বলে সাইন করিয়ে নিলেন, আর অন্য কাগজ ফাইনালাইজ করলেন—এটা হয় না। বিএনপির এই অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে ঐকমত্য কমিশনের নিরপেক্ষতা ভীষণভাবে নষ্ট হয়েছে।”

২. সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও আইনি দুর্বলতা

সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক জুলাই সনদের সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলেছেন:

  • সংবিধান বাতিল অপরিহার্য: সনদে সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত ৪৮টি বিষয়ের বেশির ভাগই বিদ্যমান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বিশেষত, বর্তমানে এক কক্ষের জাতীয় সংসদ থাকার বিপরীতে সনদে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করা হয়েছে। তিনি বলেন, জুলাই সনদের প্রস্তাব বলবৎ করতে হলে বর্তমান সংবিধানকে বাতিল করতে হবে। সংবিধান বাতিল না করে সাংঘর্ষিক ধারা বলবৎ করা সম্পূর্ণ অবাস্তব
  • বাতিলযোগ্য প্রস্তাব: আমাদের সংবিধানে ১৭টি সংশোধনী আনা হয়েছিল, যার মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট ছয়টি সংশোধনীকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল করেছেন। জুলাই সনদের প্রস্তাবগুলোও সাংঘর্ষিক হলে তা বাতিলযোগ্য হবে।
  • আইনি জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন: তিনি অভিযোগ করেন, “এটা (জুলাই সনদ) একেবারেই গোজামিল। যাঁরা এর সঙ্গে জড়িত তাঁদের আইনের ন্যূনতম ব্যাকরণ সম্পর্কে ধারণা আছে বলে মনে হয় না।”

৩. গণভোটের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন

ড. শাহদীন মালিক পুরো সনদের ওপর গণভোট আয়োজনের প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন:

  • অসংখ্য বিষয়ে গণভোট অবান্তর: তিনি বলেন, পুরো সনদে সব মিলিয়ে ৮৪টি ধারা রয়েছে। “এত বড় দলিল পড়ে বোঝার মতো দেশের ভোটারসংখ্যা তো ১৫ শতাংশও হবে না।” তিনি স্পষ্ট করেন, গণভোট হয় একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের ওপর (যেমন ব্রিটেনে ব্রেক্সিট)। ৪৮টি বিষয়ে গণভোটের প্রশ্নটাই অবান্তর।
  • পূর্বনির্ধারিত ফল: সনদে বলা হয়েছে, সংসদে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব পাস না করলে পাস বলে গণ্য হবে। শাহদীন মালিকের মতে, ফল যদি পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকে, তাহলে এত দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার কোনো যৌক্তিকতা থাকে না।

৪. আইনের শাসনের টালমাটাল অবস্থা

শাহদীন মালিক সতর্ক করে বলেন, সাংবিধানিক আদেশ জারির যে প্রস্তাব এসেছে, তা কোনো আইনে নেই। “আইনে নেই এমন অনেক কিছুই আমরা করছি। এর ফলে দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।” তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে আপিল বেঞ্চে শুনানি চলমান থাকা সত্ত্বেও জুলাই সনদে এটি কীভাবে কার্যকর হবে তা ঠিক করে দেওয়ার সমালোচনা করেন। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, এই এলোমেলো অবস্থা ঠিক করতে ২০ বছর লাগবে এবং দীর্ঘ সময় ধরে এর খেসারত দিতে হবে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top