‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়নের রূপরেখা: সংবিধান সংস্কার আদেশের খসড়া হস্তান্তর

দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ফসল ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’ বাস্তবায়নের উপায়-সম্পর্কিত সুপারিশমালা আনুষ্ঠানিকভাবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করেছে ঐকমত্য কমিশন।

মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) দুপুরে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ এই সুপারিশ তুলে দেন। এ সময় কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ইফতেখারুজ্জামান, বদিউল আলম মজুমদার সহ অন্যান্য সদস্য ও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।

কমিশন কর্তৃক সুপারিশকৃত ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’-এর খসড়ার মূল বিষয়বস্তু এবং রূপরেখা নিচে তুলে ধরা হলো:

১. আদেশের যৌক্তিকতা: গণঅভ্যুত্থানের সার্বভৌম ক্ষমতা

এই আদেশ জারির প্রধান যৌক্তিক ভিত্তি হলো ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সফল গণ-অভ্যুত্থান, যার মাধ্যমে জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে। আদেশের খসড়ায় স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে, সরকার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশিত জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা ও অভিপ্রায়ের ভিত্তিতেই এই আদেশ জারি করছে।

  • ঐকমত্য কমিশন: ড. ইউনূসের সরকার কর্তৃক গঠিত ঐকমত্য কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে এই জুলাই জাতীয় সনদ প্রণয়ন করেছে।
  • গণভোটের প্রয়োজনীয়তা: সংবিধানে সংস্কার বিষয়ে সনদে অন্তর্ভুক্ত প্রস্তাবসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী জনগণের অনুমোদন প্রয়োজন। তাই গণভোট অনুষ্ঠান এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন অপরিহার্য।

২. সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া: গণভোট ও দ্বৈত পরিষদ

আদেশে জুলাই সনদের সংস্কারগুলো কার্যকর করার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেওয়া হয়েছে, যেখানে গণভোট এবং একটি বিশেষ পরিষদের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে:

  • গণভোটের প্রশ্ন: জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতা প্রয়োগের উদ্দেশ্যে এই আদেশ এবং সনদের সংবিধান সংস্কার অংশটি গণভোটে উপস্থাপন করা হবে। ব্যালটে প্রশ্ন থাকবে: ‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং ইহার তফসিল-১ এ সন্নিবেশিত সংবিধান সংস্কার প্রস্তাবসমূহের প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করিতেছেন?’
  • সময়কাল: গণভোট জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বা নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠিত হতে পারে।

সংবিধান সংস্কার পরিষদ (Constituent Power)

  • পরিষদ গঠন: গণভোটের ফল ইতিবাচক (হ্যাঁ সূচক) হলে, আসন্ন জাতীয় সংসদের সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে।
  • দ্বৈত দায়িত্ব: নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ একইসঙ্গে জাতীয় সংসদের সদস্য এবং সংবিধান সংস্কার পরিষদের সদস্য হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
  • সংস্কারের সময়সীমা: পরিষদ উহার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ থেকে ২৭০ পঞ্জিকা দিবসের (প্রায় ৯ মাস) মধ্যে জুলাই জাতীয় সনদ অনুসারে সংবিধান সংস্কার সম্পন্ন করবে।
  • ক্ষমতা: পরিষদ সংবিধান সংস্কার বিষয়ে গাঠনিক ক্ষমতা (Constituent Power) প্রয়োগ করতে পারবে।

৩. উচ্চকক্ষ গঠন এবং পিআর পদ্ধতি

সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর উচ্চকক্ষ গঠনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার সুপারিশ করা হয়েছে:

  • গঠন প্রক্রিয়া: সংস্কার সম্পন্ন হওয়ার ৪৫ পঞ্জিকা দিবসের মধ্যে নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (Proportional Representation-PR) পদ্ধতিতে একটি উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে।
  • কার্যকারিতা: উচ্চকক্ষ গঠনের পর সংস্কারগুলো অবিলম্বে কার্যকর করা হবে।
  • মেয়াদ: উচ্চকক্ষের মেয়াদ হবে এই আদেশ জারির অব্যবহিত পরে গঠিত নিম্নকক্ষের (জাতীয় সংসদের) মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত।

৪. আদেশের আইনি ও কার্যকরতা

  • শপথ গ্রহণ: নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সংসদ সদস্য হিসাবে শপথ গ্রহণের পর একই অনুষ্ঠানে পরিষদের সদস্য হিসাবেও শপথ গ্রহণ করবেন।
  • চূড়ান্ত অনুমোদন: পরিষদ কর্তৃক গৃহীত সংবিধান সংস্কার চূড়ান্ত হবে এবং অন্য কোনোভাবে অনুমোদন বা সম্মতির প্রয়োজন হবে না, কারণ পরিষদ সার্বভৌম জনগণের অভিপ্রায়ের ভিত্তিতে গঠিত।
  • সংরক্ষণ: প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস কমিশনের সব নথি, আলোচনার ভিডিও, অডিও ও ছবি সংরক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top