উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) ও সমমানের পরীক্ষার ২০২৫ সালের ফলাফলে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে এসেছে। গত বছরের তুলনায় এবার পাসের হার যেমন কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে, তেমনি অর্ধেকে নেমেছে জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা, যা শিক্ষা ব্যবস্থাপনার মান নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে।
বিপর্যয়ের পরিসংখ্যান ও সরকারি ব্যাখ্যা
এ বছর পরীক্ষায় পাসের হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৮.৮৩ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৭৭.৭৮ শতাংশ। আরও উদ্বেগজনক হলো, জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৬ হাজার ৮১৪ জন কমে দাঁড়িয়েছে ৬৯ হাজার ৯৭ জনে, যা গত বছরের (১,৪৫,৯১১ জন) তুলনায় প্রায় অর্ধেক।
অন্যদিকে, শতভাগ ফেল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৬৫টি থেকে বেড়ে ২০২টিতে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এই বিশাল ধসের প্রধান কারণ হিসেবে ‘ন্যায্য মূল্যায়ন’ বা ‘ওভারমার্কিং না করা’-কে চিহ্নিত করেছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা এই ফলকে ব্যর্থতা না দেখে ‘আত্মসমালোচনার সুযোগ’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “আমরা অতিরিক্ত নম্বর দিয়ে সন্তুষ্টি নয়, বরং ন্যায্য নম্বর দিয়ে সততাকে বেছে নিয়েছি।” তিনি ভবিষ্যতে তিনটি নীতিতে এগোনোর ঘোষণা দেন: বাস্তবতাকে বোঝা, দোষারোপ না করে সমাধান খোঁজা এবং শেখার মানকে সাফল্যের মাপকাঠি করা।
বিশেষজ্ঞদের চোখে গলদ: ‘দায়ী শিক্ষা ব্যবস্থাপনা’
ফলাফলের এই চিত্রকে ‘অপ্রত্যাশিত নয়, তবে হোঁচট খাওয়ানোর মতো’ বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা মেনে নিলেও, মূল কারণ হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থাপনার গভীরে গলদ থাকার কথা জোর দিয়ে বলেছেন।
তিনি বলেন, “এ জন্য শিক্ষার্থীরা দায়ী না। দায়ী হচ্ছে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাপনা।” এই শিক্ষাবিদের মতে, ফল বিপর্যয়ের অন্যান্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- শিক্ষক স্বল্পতা ও মর্যাদা: বিশেষত মফস্বলের কলেজগুলোতে শিক্ষক নেই; শিক্ষকদের বেতন-ভাতা ও মর্যাদার জন্য মাঠে নামতে হয়।
- বিনিয়োগের অভাব: শিক্ষায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ না করা।
- শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা: মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীনও শিক্ষাঙ্গনে ‘শিক্ষামুখী পরিবেশ না থাকা’-কে ফলাফলের অবনতির জন্য দায়ী করেছেন।
- কোচিং বাণিজ্য: অর্থ ব্যয়ের সঙ্গে ফলাফলের মান সংযুক্ত হওয়া।
রাশেদা কে চৌধুরী **‘নিবিড় গবেষণা’**র মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার সব অংশ—শিক্ষক, অভিভাবক, এবং ব্যবস্থাপকদের দায় চিহ্নিত করার ওপর জোর দেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, লাখ লাখ শিক্ষার্থী ফেল করল, তাদের দায় কে নেবে?
বিষয়ভিত্তিক দুর্বলতা ও বোর্ড-ওয়ারী পার্থক্য
শিক্ষাবিদরা বলছেন, এবারের ফল বিপর্যয়ের প্রধান কারণ ইংরেজি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) এবং উচ্চতর গণিতে শিক্ষার্থীদের খারাপ ফল।
- ইংরেজিতে অবনতি: নয়টি সাধারণ বোর্ডের মধ্যে ইংরেজিতে গড় নম্বরের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে যশোর শিক্ষা বোর্ড (৫৪.৮২ শতাংশ), আর সবচেয়ে ভালো করেছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড (৭৫.১৬ শতাংশ)।
- অন্যান্য বিষয়ে: বাংলায় সর্বোচ্চ গড় নম্বর পেয়েছে রাজশাহী বোর্ড (৯৪.৩১ শতাংশ), আর সর্বনিম্ন বরিশাল বোর্ড (৮৫.৮৮ শতাংশ)।
- কুমিল্লা বোর্ডের কারণ: কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, সুষ্ঠু পরীক্ষার স্বার্থে ১৬২টি ভেন্যু কেন্দ্র তুলে দেওয়া এবং যথাযথ মূল্যায়ন নিশ্চিত করার কারণেই বোর্ডে পাসের হারে প্রভাব পড়েছে।
সামনের সপ্তাহেই এই ফল বিপর্যয়ের আসল কারণ চিহ্নিত করতে একটি পর্যালোচনা ও সার্ভে পরিচালনা করা হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে।







