যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান দুটি ভাষা ইংরেজি ও স্প্যানিশ ছাড়াও প্রায় ৮০০টি ভাষা ও উপভাষায় কথা বলা মানুষ বাস করে। ভাষাবৈচিত্র্যের দিক থেকে এটি বিশ্বের অন্যতম অগ্রণী দেশ। দেশটির ২০২৫ সালের জনগণনা অনুযায়ী জনসংখ্যা ৩৪ কোটি ৬৮ লাখ। এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ সমাজে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর অবস্থান ও প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে।
জনসংখ্যা ও নিউইয়র্কে দ্রুত বিকাশ
যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বৈধভাবে বসবাসকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত লোকসংখ্যা তিন লাখের বেশি, যার মধ্যে এক লাখেরও বেশি বাস করে নিউইয়র্ক সিটিতে। নিউইয়র্কের ৯০ লাখ জনসংখ্যার এক শতাংশের বেশি এখন বাংলাদেশি। ইউএস সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে নিউইয়র্কে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত জনসংখ্যা ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এ শহরে তাদের অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল জনগোষ্ঠী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
মূলধারার রাজনীতিতে বাংলাদেশি বিজয়
নিউইয়র্ক সিটিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশিদের মূলধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণও বেড়েছে। সিটি কাউন্সিল থেকে শুরু করে স্টেট অ্যাসেম্বলি এবং বিচার বিভাগেও তারা সফলতা পাচ্ছেন:
নিউইয়র্ক সিটি ও স্টেট
- শাহানা হানিফ (সিটি কাউন্সিলর): ২০২১ সালের সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে (ডিস্ট্রিক্ট-৩৯) বিজয়ী হয়ে তিনি ৫১ আসনবিশিষ্ট নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলে প্রথম মুসলিম এবং প্রথম মুসলিম নারী সদস্য হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। চলতি বছর তিনি ৭০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় মেয়াদেও বিজয় নিশ্চিত করেছেন।
- সোমা সাঈদ (বিচারক): ২০২১ সালে নিউইয়র্ক সিটি সিভিল কোর্টের বিচারক নির্বাচিত হন। তিনি ২০২৫ সালের নভেম্বরের নির্বাচনে আরও উচ্চতর পদ নিউইয়র্ক সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
- মেরি জোবাইদা ও মাহতাব খান: বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেরি জোবাইদা নিউইয়র্ক স্টেট অ্যাসেম্বলি নির্বাচনে ডিস্ট্রিক্ট-৩৬ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এছাড়া মাহতাব খান ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী হিসেবে ডিস্ট্রিক্ট-২৪ থেকে আগামী নির্বাচনে লড়বেন।
অন্যান্য অঙ্গরাজ্যে সাফল্য
নিউইয়র্কের বাইরেও বাংলাদেশি-আমেরিকানরা স্থানীয় সরকার ও অঙ্গরাজ্যের আইনসভায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন:
- জর্জিয়া: শেখ এম রহমান জর্জিয়া সিনেট ডিস্ট্রিক্ট-৫ থেকে চতুর্থ মেয়াদে নির্বাচিত হয়েছেন (প্রথম মুসলিম ও প্রথম এশিয়ান সিনেটর)। একই রাজ্যে নাবিলাহ ইসলাম দ্বিতীয় মেয়াদে প্রথম মুসলিম নারী সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন।
- কানেকটিকাট: মাসুদুর রহমান রেকর্ড সংখ্যক (৩৩ হাজারের বেশি) ভোট পেয়ে কানেকটিকাটের সিনেট ডিস্ট্রিক্ট-৪ থেকে দ্বিতীয় মেয়াদে স্টেট সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন।
- ভার্জিনিয়া: সাদ্দাম সেলিম সিনেট ডিস্ট্রিক্ট-৩৭ থেকে সিনেটর নির্বাচিত হয়েছেন।
- নিউ জার্সি: ড. নূরান নবী ২০০৭ সাল থেকে প্লেইন্সবরো টাউনশিপ কাউন্সিল থেকে টানা পঞ্চম মেয়াদে কাউন্সিলম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
- মিশিগান: জাহাঙ্গীর আলম মিশিগানের হ্যামট্রামাকে স্কুল বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হন, যা কোনো মার্কিন স্কুল বোর্ডের প্রথম বাংলাদেশি নির্বাচিত প্রতিনিধি।
আইনশৃঙ্খলা ও পেশাগত অগ্রগতি
যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম ও প্রভাবশালী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিউইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট (এনওয়াইপিডি)-এ বাংলাদেশি-আমেরিকানদের ব্যাপক অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো।
- এনওয়াইপিডি-তে অংশগ্রহণ: এনওয়াইপিডির প্রায় ৩৩ হাজার ইউনিফর্মধারী পুলিশ সদস্যের মধ্যে এক হাজারের বেশি সদস্য বাংলাদেশি কমিউনিটি থেকে নিয়োগ পেয়েছেন। এছাড়াও প্রায় ১৯ হাজার বেসামরিক কর্মীর মধ্যে প্রায় দেড় হাজার বাংলাদেশি-আমেরিকান রয়েছেন।
- পদমর্যাদা: বর্তমানে এনওয়াইপিডি-তে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ১২ জন ডিটেকটিভ, ৮২ জন সার্জেন্ট, ২০ জন লেফটেন্যান্ট, ৪ জন ইন্সপেক্টর এবং ৫ জন ক্যাপ্টেন রয়েছেন। ক্যাপ্টেন কারাম চৌধুরী বর্তমানে বাংলাদেশি-আমেরিকান পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) প্রেসিডেন্ট।
- ইতিহাস ও বেতন: ৯/১১-এর ঘটনার পর অনেক বাংলাদেশি প্রথমে ট্রাফিক এনফোর্সমেন্ট অফিসার বা স্কুল সেফটি এজেন্ট (বেসামরিক চাকরি, গ্রিনকার্ডধারীরাও যোগ্য) হিসেবে যোগ দেন। পরবর্তীতে তারা ন্যাচারালাইজ্ড সিটিজেন হয়ে পুলিশ অফিসার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। এনওয়াইপিডির চাকরি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও লোভনীয়; একজন ক্যাপ্টেনের বার্ষিক বেতন অভিজ্ঞতাসহ ১,৬০,০০০ থেকে ১,৮০,০০০ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
শিক্ষা ও পেশাগত উচ্চতা:
পিউ রিসার্চ সেন্টারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২৫ বছর বয়সের মধ্যে ৫১ শতাংশ বাংলাদেশি-আমেরিকানের স্নাতক বা উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে (ব্যাচেলর ডিগ্রি ২৪% এবং উচ্চতর ডিগ্রি ২৬%)। তারা অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ান দেশের তুলনায় শিক্ষা ও চাকরিতে বেশ এগিয়ে আছেন এবং আইটি-সংশ্লিষ্ট ও করপোরেট চাকরিগুলোতেও ভালো করছেন।
সূত্র- যুগান্তর
আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু : যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক ও অনুবাদক







