সিলেট: হঠাৎ করে মেঘ জমছিল আকাশজুড়ে। আবহাওয়া অফিস তখনো কোনো সতর্কবার্তা দেয়নি, কিন্তু হাওরপাড়ের কৃষকেরা এক বুক চাপা উদ্বেগ নিয়ে আকাশ দেখছিলেন। গত বছর এই ধরনের এক হঠাৎ ঝড়ে তাদের সব ফসল তলিয়ে গিয়েছিল। তবে এবার চিত্রটা ভিন্ন। গ্রামের তরুণ রায়হানের স্মার্টফোনে আসা এক বিশেষ বার্তা তাদের সবাইকে সতর্ক করে দিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) নির্ভর আবহাওয়ার পূর্বাভাস ব্যবহার করে রায়হান গ্রামবাসীকে জানায়, আর মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে ভয়াবহ ঝড় ও বন্যা আসছে। তার কথা শুনে সবাই দ্রুত ফসল ঘরে তুলল এবং নৌকাগুলো সুরক্ষিত করল। এরপর যা ঘটল, তা এক অবিশ্বাস্য গল্প।
প্রকৃতির সঙ্গে অসম লড়াই
সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার একটি প্রত্যন্ত হাওর এলাকার এই গ্রামের মানুষের জীবন প্রকৃতির করুণার উপর নির্ভরশীল। এক ফসলি জমিতেই তাদের সারা বছরের রুজি-রোজগার। কিন্তু এখানকার আবহাওয়া এতটাই unpredictable যে এক মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু বদলে যায়। আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস সাধারণত তাদের কাছে পৌঁছায় দেরিতে, ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে যায়। গ্রামের মানুষের কাছে এটি ছিল একরকম নিয়তি।
প্রযুক্তির হাতে জীবন
রায়হান, গ্রামেরই এক সাধারণ যুবক, যার পুঁথিগত বিদ্যা কম কিন্তু প্রযুক্তির প্রতি প্রবল আগ্রহ। সে ইউটিউব দেখে দেখে স্যাটেলাইট ডাটা ও ওপেন-সোর্স এআই মডেল সম্পর্কে ধারণা নিয়েছে। সে লক্ষ্য করল, তার স্মার্টফোনের অ্যাপসগুলো স্থানীয় আবহাওয়ার পূর্বাভাসে অনেক বেশি নির্ভুল। রায়হান একটি ছোট সোলার প্যানেল ব্যবহার করে তার ফোনটি চার্জে রাখতো এবং গ্রামের সব চাষীদেরকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যুক্ত করে দেয়। প্রতিদিন সকালে সে নিজেই একটি আবহাওয়ার আপডেট দিত।
কিন্তু গত সপ্তাহের ঘটনাটি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। যখন স্থানীয় আবহাওয়া অফিস পরিষ্কার আকাশ দেখাচ্ছিল, রায়হানের এআই মডেলের পূর্বাভাসে ইঙ্গিত ছিল এক ভয়ংকর ঝড়ের। রায়হান সবাইকে দ্রুত সতর্ক করে। প্রথমে অনেকেই অবিশ্বাস করলেও, গত বছরের ক্ষতির কথা মনে করে তারা ঝুঁকি নিতে চায়নি। এরপর সত্যিই অপ্রত্যাশিতভাবে আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে, সঙ্গে যোগ হয় ঝড় এবং বন্যা। রায়হানের সতর্কবার্তার কারণে গ্রামের কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলো না।
গ্রামের নতুন পথপ্রদর্শক
ঝড় থামার পর গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক কৃষক হাতেম আলী এসে রায়হানকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি বললেন, “আমরা এতদিন প্রকৃতির কাছে অসহায় ছিলাম। কিন্তু আজ আমাদের গ্রামের এক ছেলে, শুধু তার বুদ্ধি দিয়ে আমাদের জীবন বাঁচিয়ে দিয়েছে। এ আমাদের এক নতুন লড়াই, প্রযুক্তির সাথে।”
রায়হানের এই উদ্যোগ প্রমাণ করে, বড় সমস্যা সমাধানের জন্য সবসময় বড় বাজেটের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় সামান্য উদ্ভাবনী চিন্তা এবং স্থানীয় সমস্যার প্রতি সংবেদনশীলতা। হাওরপাড়ের এই ‘নীরব নায়ক’ এখন কেবল একজন প্রযুক্তিপ্রেমী নয়, বরং তার গ্রামের মানুষের জন্য নতুন আশার প্রতীক।