বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত সন্দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের মেঘনা নদীর মোহনায় অবস্থিত একটি প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী দ্বীপ। এটি সন্দ্বীপ চ্যানেল দ্বারা চট্টগ্রাম উপকূল থেকে বিচ্ছিন্ন। সন্দ্বীপের রয়েছে প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো এক সমৃদ্ধ ইতিহাস ও স্বতন্ত্র ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য।
ভৌগোলিক অবস্থান ও নামকরণ
সন্দ্বীপ বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব দিকে, বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কাছে অবস্থিত। এটি প্রায় ৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৫-১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত। উত্তরে বামনী নদী, পশ্চিমে মেঘনা নদী ও হাতিয়া দ্বীপ, পূর্বে সন্দ্বীপ চ্যানেল এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর দ্বারা এটি পরিবেষ্টিত। এককালে এর আয়তন অনেক বেশি থাকলেও, নদী ভাঙনের কারণে বর্তমানে এটি আকারে ছোট হয়েছে।
সন্দ্বীপ নামের উৎপত্তি নিয়ে বেশ কিছু মত প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন, বাগদাদ থেকে চট্টগ্রামে আসা ১২ জন আউলিয়া জনমানবশূন্য এই দ্বীপটি আবিষ্কার করে একে ‘শূন্য দ্বীপ’ নাম দিয়েছিলেন, যা থেকে ‘সন্দ্বীপ’ নামটি এসেছে। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, ইউরোপীয়রা দূর থেকে এই দ্বীপকে বালির স্তূপ (‘স্যান্ড-হিপ’) হিসেবে দেখে অভিহিত করতেন, যা কালক্রমে ‘সন্দ্বীপ’ নামে পরিচিত হয়। অনেক পণ্ডিত একে ‘স্বর্ণদ্বীপ’ বলেও অভিহিত করতেন, যার উর্বরতা ও প্রাচুর্যের কারণে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
সন্দ্বীপের ইতিহাস বেশ বর্ণাঢ্য। এটি বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন শাসক, যেমন দেলোয়ার খান, মোগল এবং আরাকানিজ জলদস্যুদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। সপ্তদশ শতাব্দীতে এটি পর্তুগিজ ও আরাকানিজ জলদস্যুদের দুর্গে পরিণত হয়েছিল এবং তাদের স্থাপত্যের কিছু নিদর্শন আজও দ্বীপে দেখা যায়। ১৬৬৫ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব দেলোয়ার খানকে পরাজিত করে সন্দ্বীপকে মোগল শাসনের অধীনে আনেন। ব্রিটিশ শাসনামলেও এটি প্রশাসনিক জটিলতার মধ্যে ছিল এবং ১৯৪৭ সালে এটি নোয়াখালী জেলার অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ১৯৫৪ সালে চট্টগ্রাম জেলার অংশ হয়। ১৯৮৪ সালে সন্দ্বীপ থানাকে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়।
স্বন্দীপ ফেরিঘাট
ঐতিহাসিকভাবে সন্দ্বীপ তার লবণ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ কারখানা এবং বস্ত্র শিল্পের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত ছিল। একসময় এই অঞ্চলে উৎপাদিত লবণ ৩০০ জাহাজে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হতো। সন্দ্বীপ কম খরচে মজবুত ও সুন্দর জাহাজ নির্মাণের জন্য বিখ্যাত ছিল এবং ইউরোপসহ তুরস্কের সুলতানও এখান থেকে জাহাজ কিনে নিতেন। ১৫৬৫ সালে ভিনিসীয় পর্যটক সিজার ফ্রেডরিক সন্দ্বীপ পরিদর্শন করে এর প্রাচীন নিদর্শনের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৯ সালে সন্দ্বীপ ভ্রমণ করেন এবং এখানকার স্মৃতির পটভূমিতে তার ‘মধুবালা’ গীতিনাট্য রচনা করেন। তিনি এই দ্বীপে বসেই তার ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতা লেখেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও চ্যালেঞ্জ
সন্দ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। সবুজে ঘেরা ফসলের মাঠ, ম্যানগ্রোভ বন এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলকাকলীতে মুখরিত এই দ্বীপটি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। শীতকালে অতিথি পাখিদের আনাগোনায় দ্বীপের পরিবেশ আরও মনোরম হয়ে ওঠে।
তবে, সমুদ্রবেষ্টিত দ্বীপ হওয়ায় সন্দ্বীপ প্রায়শই ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা এবং নদী ভাঙনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হয়। বিশেষ করে, ১৯১৭, ১৮২৫, ১৮৭৬, ১৯৮৫ এবং ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস সন্দ্বীপের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছিল, যেখানে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ৬০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
সবকিছু মিলিয়ে, সন্দ্বীপ কেবল একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, এটি হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জের একটি জীবন্ত নিদর্শন। এই দ্বীপের মানুষের জীবন সংগ্রাম এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণ একে বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও আকর্ষণীয় স্থানে পরিণত করেছে।