৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুতির পর পরিত্যক্ত হয়ে পড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন ঘিরে নতুন করে রহস্য দানা বাঁধছে। রাজধানীর গুলিস্তানে অবস্থিত ১০ তলা ভবনটি একসময় ছিল দলীয় কার্যক্রমের প্রাণকেন্দ্র, যেখানে ৫ আগস্টের পর আগুন, ভাঙচুর ও লুটপাট চলেছিল। এখন সেই ভবনে চলছে জোরেশোরে সংস্কার কাজ, যা ‘আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজম ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট’ নামের একটি ব্যানারের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
এই নতুন প্রতিষ্ঠানের পরিচিতি বা এর পেছনে কারা রয়েছে, তা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। যদিও বলা হচ্ছে, দেশজুড়ে ‘জুলাই যোদ্ধারা’ এখানে বিশ্রাম নেবেন, তবে এর নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি বা সংগঠন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
অনেকে ধারণা করছেন, গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অথবা জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) তত্ত্বাবধানে এই কাজ চলছে। তবে যুগান্তরের পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কেউ-ই এর দায় নিতে রাজি হননি। পুলিশও এ বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এমতাবস্থায় কেউ কেউ মনে করছেন, এর পেছনে কোনো প্রভাবশালী মহলের ইন্ধন থাকতে পারে, যাদের উদ্দেশ্য হতে পারে এখানে দোকানপাট বসিয়ে ভাড়া দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করা। এর আগে ‘জুলাই যোদ্ধাদের প্রধান কার্যালয়’ নামে একটি ব্যানার ঝুলিয়ে ভবনটি দখলের চেষ্টা করা হয়েছিল, যা দীর্ঘদিন সেখানে টাঙানো ছিল।
গত বছর ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের সময় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা গুলিস্তানের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত আওয়ামী লীগের ১০ তলা অত্যাধুনিক কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর কয়েক দিন ধরে চলে ব্যাপক লুটপাট। ভবনটির জানালা, দরজা, গ্লাসসহ সবকিছু খুলে নিয়ে যায় যে যার মতো করে। এরপর থেকে ভবনটি পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।
শনিবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের প্রবেশমুখে ‘আন্তর্জাতিক ফ্যাসিজম ও গণহত্যা গবেষণা ইনস্টিটিউট’ লেখা একটি ব্যানার ঝুলছে। ভবনের ভেতরে চলছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ। একদল শ্রমিক নোংরা পানি, ময়লার স্তূপ, ইটের গুঁড়ো, ভাঙা টাইলসসহ জমে থাকা সব ধরনের আবর্জনা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। সিঁড়ি ও ওপরের কক্ষগুলো থেকে টাইলস তুলে ফেলা হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক এই কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
কাজের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকা সাখাওয়াত হোসেন নামের একজন যুগান্তরকে বলেন, “এটা ফ্যাসিস্ট আমলের একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আমরা চাই না এখান থেকে আবার ফ্যাসিজমের জন্ম হোক বা ফ্যাসিস্টরা নিজেদের কর্মকাণ্ড করুক। এজন্য আমরা এখানে নিজেদের কার্যক্রম শুরু করব।” তিনি আরও বলেন, “এ কাজে কারো থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন আমাদের নেই।” তবে তিনি কোনো দল বা সংগঠনের পক্ষ থেকে কাজ করছেন, সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন যুগান্তরকে বলেন, “আমরা আমাদের দলীয় কর্মসূচি নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি। কে বা কারা পতিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এভাবে দখলের চেষ্টা করছে, তা বলতে পারব না। আমাদের দলও এ বিষয়ে অবগত নয়।” বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক রিফাত রশিদ বলেন, “বিষয়টি আমরাও বিভিন্ন গণমাধ্যমে দেখেছি। তবে কারা এই কাজটা করছে, তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলার চেষ্টা করব। এরপর আমাদের পক্ষ থেকে মন্তব্য করব।”
ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল বিভাগের ডিসি (উপপুলিশ কমিশনার) মো. শাহরিয়ার জানান, “বিভিন্ন সময়ে দলটির কার্যালয়ে বিভিন্ন ব্যানার টাঙানো হয়েছে। সম্প্রতি দেখলাম, কারা যেন ব্যানার লাগিয়ে কার্যালয়টি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছে। এটা নিয়ে আমরা কিছুই জানি না। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো নির্দেশনা নেই।”
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত এক বছরে ভবনটিতে মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলায় এতটাই বাজে অবস্থা হয়েছিল যে, উৎকট গন্ধে আশপাশের দোকানদারদের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। শুধু তা-ই নয়, ভবনটি এখন ছিন্নমূল মানুষজনসহ রিকশাচালক, ভ্যানচালক ও পথচারীদের শৌচাগারে পরিণত হয়েছিল। ভাসমান মানুষের নেশা ও আড্ডাও এখানে জমত। এখন পরিষ্কার করা হচ্ছে, এতে খারাপ কিছু দেখছেন না তারা। তবে কারা পরিষ্কার করছেন – এই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার, অন্যথায় সাধারণ মানুষের মাঝে নানান প্রশ্ন ও উদ্বেগ তৈরি হবে।
মামুনুর রশিদ নামের এক ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, “ভবনটি কারা পরিষ্কার করছেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ব্যানার থাকলেও ব্যানারের পক্ষে এখন পর্যন্ত কেউ নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করেনি। কেউ কেউ বলছেন, ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল অথবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা এটা পরিষ্কার করছেন। আবার অনেকে বলছেন, ভবনটি যাতে এভাবে নষ্ট না হয়ে যায়, সেজন্য আওয়ামী লীগ নেতারা লোক ভাড়া করে কৌশলে নিজেদের পার্টি অফিস পরিষ্কার করছেন। তবে কোনটা সঠিক, তা বলা সত্যিই কঠিন।”
জানা যায়, ১৯৮১ সাল থেকে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ ঠিকানাটি দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে আসছে আওয়ামী লীগ। আট কাঠার এই জমিটি ৯৯ বছরের জন্য সরকারের কাছ থেকে ইজারা নেয় দলটি। সর্বশেষ ২০১৬ সালে পুরোনো ভবন ভেঙে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা নতুন এই ভবনটি নির্মাণ করা হয়। এর আগে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগ অফিস স্থানান্তরের ঘটনা ঘটেছে অন্তত আটবার। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আত্মপ্রকাশের পর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাসায় বসে দল পরিচালনার নীতি ও কর্মসূচি গ্রহণ করা হতো। ১৯৫৩ সালে কানকুন বাড়ি লেনে একটি অস্থায়ী অফিস ব্যবহার করত আওয়ামী লীগ। ১৯৫৬ সালে পুরান ঢাকার সিমসন রোডের ঠিকানায় যায় আওয়ামী লীগের অফিস। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান নবাবপুর রোডে দলীয় অফিস নেন। এর কিছুদিন পর অস্থায়ীভাবে সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলের গলিতে বসা শুরু করেন আওয়ামী লীগ নেতারা। পরে পুরানা পল্টনে দুটি স্থানে দীর্ঘদিন দলের অফিস ছিল। ১৯৮১ সালের দিকে শেখ হাসিনা দলের দায়িত্ব নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা হয় গুলিস্তান ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, যা দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে পরিচিত। সূত্র- যুগান্তর