বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় চুক্তি ও ব্যাংকিং খাত থেকে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করে সেগুলো যুক্তরাজ্যে পাচার করে বিশাল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, বাংলাদেশে যখন এসব ব্যক্তির সম্পত্তির বিষয়ে তদন্ত চলছে, তখন তারা যুক্তরাজ্যে তাদের সম্পত্তি বিক্রি, বন্ধক বা হস্তান্তর করছেন। সাংবাদিক রব ডেভিস এর লেখা এই প্রতিবেদনটি গত ১৯ জুলাই প্রকাশিত হয়।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রায় এক বছর হতে চললেও, দেশটির অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে বিভাজনের রাজনীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের এক জটিল বাস্তবতা মোকাবেলা করছে। এমন অস্থির প্রেক্ষাপটে লন্ডনের বিলাসবহুল সম্পত্তিগুলো বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
অর্থ পাচার ও তদন্তের আওতায় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা
ঢাকার তদন্ত কর্মকর্তারা বর্তমানে খতিয়ে দেখছেন, কীভাবে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা উচ্চপদে থেকে রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ও ব্যাংক খাত থেকে অর্থ লুট করেছেন এবং সেই অর্থ যুক্তরাজ্যে রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ করেছেন।
গত মে মাসে ব্রিটেনের জাতীয় অপরাধ দমন সংস্থা (এনসিএ) সালমান এফ রহমান পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন প্রায় ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ জব্দ করে। গার্ডিয়ানের পূর্ববর্তী এক অনুসন্ধানে এই পরিবারের যুক্তরাজ্যে থাকা সম্পত্তির বিশদ তথ্য প্রকাশিত হয়েছিল। এর তিন সপ্তাহ পর এনসিএ সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ১৭০ মিলিয়ন পাউন্ডের বেশি সম্পদ জব্দ করে। শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক ভূমিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি যুক্তরাজ্যে ৩০০টিরও বেশি সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন, যার মধ্যে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে প্রাসাদসম টাউনহাউজও রয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান এবং দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে আরও অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব বাংলাদেশি বর্তমানে ঢাকায় তদন্তের আওতায় রয়েছেন, তাদের অনেকে সরকার পতনের পর যুক্তরাজ্যে থাকা তাদের মালিকানাধীন সম্পত্তি বিক্রি, হস্তান্তর বা বন্ধক রাখছেন।
ব্রিটিশ আইন সংস্থার ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক আহ্বান
এই লেনদেনগুলো প্রশ্ন তুলেছে যে, তদন্তাধীন ব্যক্তিরা কীভাবে এখনো লন্ডনে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারছেন এবং তাদের লেনদেনে সহায়তাকারী যুক্তরাজ্যের আইন ও পরামর্শ সংস্থাগুলো কতটা সতর্ক ছিল। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যে, তারা যেন তদন্ত চলাকালে আরও সম্পত্তি জব্দ করে ‘সতর্কতার পক্ষেই’ অবস্থান নেয়। অনেকে এটিকে বহু প্রতীক্ষিত দুর্নীতিবিরোধী অভিযান হিসেবে দেখলেও কেউ কেউ এটিকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলেও মনে করছেন।
জুনের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল লন্ডন সফর করে। এই সফরের অন্যতম লক্ষ্য ছিল যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করা। লন্ডন বাংলাদেশের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সেখানে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি বাস করেন এবং যুক্তরাজ্য সরকার বাংলাদেশকে পাচারকৃত সম্পদ শনাক্তে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে, যা ঢাকার তদন্তকারীদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, যিনি পাচার হওয়া সম্পদ দেশে ফেরত আনার উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তিনি বলেছেন যে, সালমান এফ রহমান ও সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পত্তির মতো আরও সম্পত্তি জব্দ করার আদেশ প্রয়োজন। তিনি উল্লেখ করেন, “আমরা জানি অনেকেই এখন সম্পদ বিক্রি করতে চাচ্ছে। তাই আমরা চাই, ইউকে সরকার আরও সম্পত্তি জব্দ করুক। লেনদেন বন্ধ রাখার পদক্ষেপগুলো আমাদের আশাবাদী করে তোলে, যাতে আমরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে এসব সম্পদ দেশে ফেরত আনতে পারি।”
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, তিনি ইতোমধ্যে এনসিএকে অনুরোধ করেছেন যেন তারা আরও কিছু ব্যক্তির সম্পত্তি জব্দ করার কথা বিবেচনা করে, কারণ গত কয়েক মাসে এই সম্পত্তি কেনাবেচার বাজারে ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেছে।
উল্লেখযোগ্য সম্পত্তি লেনদেন ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা
যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে তদন্তাধীন ব্যক্তিদের মালিকানাধীন সম্পত্তির বিষয়ে অন্তত ২০টি ‘অ্যাপ্লিকেশন ফর ডিলিং’ বা লেনদেনের আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে তিনটি সম্পত্তির মূল্য প্রায় ২৪.৫ মিলিয়ন পাউন্ড, যেগুলোর মালিকানা বসুন্ধরা গ্রুপের সোবহান পরিবারের সদস্যদের। এই তিনটি সম্পত্তির একটি হলো নাইটসব্রিজে অবস্থিত চারতলা টাউনহাউস, যেটি সম্প্রতি দুইবার লেনদেন হয়েছে। গত বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই সম্পত্তির সরাসরি মালিক ছিলেন বসুন্ধরার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর, যিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতে নিবন্ধিত একটি কোম্পানির মাধ্যমে এর মালিকানা লাভ করেন। দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যমতে, সোবহান পরিবারের কয়েকজন সদস্যের বিরুদ্ধে অর্থপাচারসহ নানা অভিযোগে তদন্ত করছে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গত এপ্রিল মাসে ওই সম্পত্তিটি সম্ভবত বিনামূল্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘ব্রুকভিউ হাইটস লিমিটেড’-এর কাছে হস্তান্তর করা হয়। এই কোম্পানিটি পরিচালনা করেন অরবিস লন্ডন নামের একটি রিয়েল এস্টেট পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, যাদের অফিস রয়েছে লিচেনস্টাইন ও সিঙ্গাপুরে। অতীতেও তারা সোবহান পরিবারের পক্ষে সম্পত্তি কেনাবেচায় কাজ করেছে। পরবর্তীতে লন্ডনের এই বাড়িটি ৭.৩৫ মিলিয়ন পাউন্ডে নতুন আরেকটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করা হয়।
যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন কার্যালয়ের নথিতে আরও দেখা যায়, সোবহান পরিবারের আরেক সদস্য শাফিয়াত সোবহানের মালিকানাধীন সম্পত্তি নিয়ে আরও দুটি লেনদেনের আবেদন করেছে ব্রিটিশ আইনজীবী প্রতিষ্ঠানগুলো। এসবের মধ্যে রয়েছে সারে’র ভার্জিনিয়া ওয়াটারে ৮ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রাসাদতুল্য একটি বাসভবন। দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, এ বিষয়ে সোবহান পরিবারের একজন সদস্যও মন্তব্য করতে রাজি হননি, তবে এর আগে তারা সব ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং আইনগতভাবে লড়াইয়ের কথা বলেছেন।
অন্যান্য অভিযুক্তদের সম্পত্তি ও আইনগত প্রতিক্রিয়া
দুদক সাইফুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে আরও দুই ব্যক্তির ওপর নজরদারি করছে, যারা গত এক বছরে একাধিক সম্পত্তি লেনদেনে জড়িত ছিলেন। তাদের একজন হলেন সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই আনিসুজ্জামান, অন্যজন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এক সফল সম্পত্তি ব্যবসায়ী, যার নাম গার্ডিয়ান প্রকাশ করেনি।
যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন কার্যালয়ের তথ্যমতে, আনিসুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন চারটি সম্পত্তি নিয়ে সম্প্রতি লেনদেনের তৎপরতা দেখা গেছে। এই সম্পত্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে রিজেন্টস পার্কের সন্নিকটে অবস্থিত ১০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটি জর্জিয়ান টাউনহাউস, যেটির বিক্রয়প্রক্রিয়া গত বছরের জুলাইয়ে সম্পন্ন হয়েছে। আরও তিনটি লেনদেনের আবেদন হয়েছে, যা পুনঃঅর্থায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে ধারণা করা হচ্ছে। আনিসুজ্জামান চৌধুরীর আইনজীবীরা জানান, সম্পদ জব্দ করার কোনো বৈধ কারণ নেই বলে তারা মনে করেন এবং রিজেন্টস পার্কের ওই সম্পত্তি ২০২৩ সালেলেই বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, যা আন্দোলনের আগেই হয়েছিল।
এছাড়া, সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ শায়ান রহমান এবং ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের মালিকানাধীন আরও তিনটি সম্পত্তি লেনদেনের আবেদন করা হয়েছে। সালমান এফ রহমান বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার। এই সম্পত্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে লন্ডনের অভিজাত মেফেয়ারের গ্রোসভেনর স্কয়ারে অবস্থিত ৩৫ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের একটি অ্যাপার্টমেন্ট, যা ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) গত মাসেই জব্দ করেছে। রহমান পরিবারের আইনজীবীরা যেকোনো ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন যে, বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার ফলে অনেকের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ উঠছে, তবে যুক্তরাজ্যে যেকোনো তদন্ত হলে তারা তাতে অংশগ্রহণ করবেন।
দ্রুত পদক্ষেপের আহ্বান: আন্তর্জাতিক উদ্বেগ
যুক্তরাজ্যের এমপি এবং দুর্নীতি ও কর ফাঁকি সংক্রান্ত অল-পার্টি পার্লামেন্টারি গ্রুপের চেয়ারম্যান জো পাওয়েল বলেছেন, তিনি চান এ ধরনের যেকোনো তদন্ত যেন দ্রুত হয়। তিনি সতর্ক করে বলেন, “ইতিহাস আমাদের শেখায় যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে সম্পদ মুহূর্তেই গায়েব হয়ে যেতে পারে। তাই তদন্ত চলাকালীনই তা জব্দ করা জরুরি।”
ব্রিটিশ লেবার পার্টির এমপি জো পাওয়েল এনসিএ-এর নেওয়া পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং যত দ্রুত সম্ভব তদন্তের পরিধি আরও বাড়ানোর আহ্বান জানান। তিনি এমন একটি সংসদীয় দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন যারা লন্ডনে সন্দেহজনক অর্থের আশ্রয়স্থল হওয়ার অভিযোগ এবং এই ধনের সম্পদ স্থানান্তরের সহায়কদের ভূমিকা নিয়ে কাজ করছেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের একজন মুখপাত্র বলেন, যেসব পেশাদার সেবা প্রতিষ্ঠান (যেমন – আইন বা পরামর্শক সংস্থা) তদন্ত চলছে এমন ক্লায়েন্টদের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করে, তাদের উচিত আরও সতর্কতা অবলম্বন করা। তাদের উচিত সম্পদের উৎস নিয়ে সম্পূর্ণ যাচাই-বাছাই করা এবং কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো। তিনি আরও বলেন, যদি দ্রুত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে এই অর্থগুলো আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকবে এবং একবার হারিয়ে গেলে তা উদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।