২০০০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিভিন্ন গবেষণা সংস্থা, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এবং সংঘাত পর্যবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে আনুমানিক লক্ষ লক্ষ মুসলিম সংঘাতের শিকার হয়ে নিহত হয়েছেন। তবে, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে তথ্যের সীমাবদ্ধতা, নিহতদের ধর্মীয় পরিচয় যাচাইয়ের চ্যালেঞ্জ এবং সহিংসতার বিভিন্ন মাত্রার (যেমন – যুদ্ধ, রাজনৈতিক দমন, সন্ত্রাসী হামলা, জাতিগত সংঘাত) কারণে সুনির্দিষ্ট ও নিখুঁত পরিসংখ্যান পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।
সংঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রধান অঞ্চল ও আনুমানিক হতাহতের সংখ্যা:
- ইরাক: ২০০৩ সালের পর ইরাক যুদ্ধ এবং পরবর্তীকালে ইসলামিক স্টেটের (আইএস) উত্থান ও তাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানগুলো দেশটিতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘কস্টস অফ ওয়ার’ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইরাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫ লাখ (০.৫ মিলিয়ন) মানুষ নিহত হয়েছেন বলে অনুমান করা হয়, যাদের একটি বড় অংশ মুসলিম বেসামরিক নাগরিক।
- আফগানিস্তান: ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসন এবং পরবর্তী দুই দশক ধরে চলা সংঘাত আফগানিস্তানে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটিয়েছে। ‘কস্টস অফ ওয়ার’ প্রকল্পের তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে সরাসরি যুদ্ধ সংক্রান্ত কারণে কমপক্ষে ৪ লাখ ৮ হাজার ৭৪৯ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন, যাদের অধিকাংশই মুসলিম। পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা ধরলে এটি ৪.৫ থেকে ৪.৭ মিলিয়ন (৪৫-৪৭ লাখ) ছাড়িয়ে যেতে পারে।
- সিরিয়া: ২০১১ সাল থেকে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘাতগুলোর একটি। বিভিন্ন অনুমান অনুযায়ী, এই যুদ্ধে প্রায় ৫ লাখ থেকে ৬ লাখ মানুষ নিহত হয়েছেন বলে ধারণা করা হয়, যার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলিম বেসামরিক নাগরিক।
- ইয়েমেন: ২০১৪ সাল থেকে শুরু হওয়া ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ এবং সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের হস্তক্ষেপ দেশটিতে এক ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি করেছে। এই সংঘাতে সরাসরি হাজার হাজার মুসলিম প্রাণ হারিয়েছেন, তবে দুর্ভিক্ষ, রোগ এবং স্বাস্থ্যসেবার অভাবে পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি।
- ফিলিস্তিন (গাজা ও পশ্চিম তীর): ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত, বিশেষ করে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানগুলো ব্যাপক প্রাণহানি ঘটিয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া সংঘাতে গাজায় অন্তত ৫৮,০০০ জনের বেশি (৫৮ হাজার) মানুষ নিহত এবং ১,৩৮,০৯৫ জন আহত হয়েছেন (জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত), যাদের অধিকাংশই ফিলিস্তিনি মুসলিম বেসামরিক নাগরিক।
- আফ্রিকায় জঙ্গি সহিংসতা: ফন্ডাপল এবং আফ্রিকা সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, আফ্রিকায় জঙ্গি ইসলামপন্থী সহিংসতায় (যেমন সোমালিয়ায় আল-শাবাব, নাইজেরিয়ায় বোকো হারাম, সাহেল অঞ্চলে) উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রাণহানি ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ, কেবল ২০২৪ সালেই আফ্রিকায় জঙ্গি ইসলামপন্থী সহিংসতায় আনুমানিক ১৮,৯০০ জন নিহত হয়েছেন।
- সন্ত্রাসী হামলা: ফন্ডাপলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭৯ থেকে এপ্রিল ২০২৪ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে ইসলামী সন্ত্রাসী হামলায় কমপক্ষে ২,৪৯,৯৪১ জন মানুষ নিহত হয়েছেন। এর প্রায় ৮৮.৯% নিহত হয়েছেন মুসলিম দেশগুলোতেই, যার বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলিম।
- ভারত: ২০০০-২০২৫ সময়কালের মধ্যে ভারতে মুসলিমদের উপর বড় ধরনের সহিংসতার মধ্যে ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গা উল্লেখযোগ্য, যেখানে ১০০০ থেকে ২০০০ মানুষ নিহত হয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়, যাদের বেশিরভাগই মুসলিম।
আনুমানিক মোট আহত:
আহতের সংখ্যা নিরূপণ করা মৃত্যুর সংখ্যার চেয়েও কঠিন, কারণ অনেক ক্ষেত্রে আহতদের সঠিক পরিসংখ্যান রেকর্ড করা হয় না বা সহজলভ্য থাকে না। তবে, প্রধান সংঘাতগুলোতে আহতের সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন (লাখ লাখ) হতে পারে।
- কেবল গাজা-ইসরায়েল সংঘাতেই (অক্টোবর ২০২৩ থেকে জুলাই ২০২৫) ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।
- ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া এবং ইয়েমেনের মতো দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতগুলোতে আহত, পঙ্গু এবং মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত মানুষের সংখ্যাও লাখ লাখ।
উপসংহার:
২০০০ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত যুদ্ধ ও রাজনৈতিক কারণে বিশ্বজুড়ে নিহত মুসলিমদের মোট সংখ্যা ৪০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষের বেশি হতে পারে, এবং আহতের সংখ্যা কয়েক মিলিয়ন হতে পারে। এই সংখ্যাগুলো বিশাল মানবিক বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয় এবং সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া, অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার অভাবে পরোক্ষ মৃত্যুর সংখ্যা ধরলে প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ হতে পারে।