বাংলাদেশে নির্বাচন ঘিরে নতুন অনিশ্চয়তা: পদ্ধতিগত বিতর্ক ও রাজনৈতিক সংশয়

২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নতুন করে সন্দেহ ও অনিশ্চয়তা দানা বেঁধেছে। নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পাল্টাপাল্টি অবস্থান এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা ঘিরে এই সংশয় আরও বাড়ছে।

লন্ডনের বৈঠক ও পরবর্তী প্রত্যাশা

গত ১২ জুন যুক্তরাজ্য সফরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে এক বৈঠকে শর্তসাপেক্ষে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার পর বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে নির্বাচনের অনিশ্চয়তা কেটে গেছে এবং ফেব্রুয়ারিতেই নির্বাচন হচ্ছে, এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছিল। এমনকি বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো নির্বাচনমুখী তৎপরতা শুরু করে দেয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-ও নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে পদযাত্রা ও গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করছে।

নতুন সংশয় ও সন্দেহ

তবে এরপরও নির্বাচনের ব্যাপারে নতুন করে সন্দেহ ও সংশয়ের কথা আসছে। অনেক রাজনীতিকই নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ার আশঙ্কা করছেন। যদিও সরকারের একাধিক উপদেষ্টা বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, নির্বাচন প্রলম্বিত করার কোনো চিন্তা তাদের নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনও বিবিসি বাংলাকে বলেছেন যে, তারা ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারছে না। এর মধ্যে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নতুন বিতর্কও যুক্ত হয়েছে। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) নাকি সরাসরি ভোট – এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য স্পষ্ট।

নির্বাচন পদ্ধতির বিতর্ক

বিএনপি ও এর মিত্র কিছু দল সংসদীয় আসনে সরাসরি ভোটের বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষেই রয়েছে। তবে জামায়াতসহ ইসলামপন্থী বিভিন্ন দল এবং কিছু বামপন্থী দল আনুপাতিক হারে ভোট এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি তুলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকারের অবস্থান এখনো অস্পষ্ট, এবং দলগুলোর এই মতপার্থক্য বা পরস্পরবিরোধী অবস্থান রাজনীতিতে অস্থিরতা ও নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়াচ্ছে।

নতুন করে সন্দেহের কারণ

রাজনীতির বাইরে সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো নির্বাচনের হাওয়া বইছে না। তবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের লন্ডন বৈঠকের যৌথ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলোর নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত হয়েছিলেন। লন্ডন বৈঠকে শর্ত দেওয়া হয়েছিল যে, সংস্কার ও গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলে রোজার আগে, অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে।

কিন্তু লন্ডন বৈঠকের তিন সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও প্রধান উপদেষ্টা বা সরকারের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনকে কোনো সুনির্দিষ্ট ইঙ্গিত বা নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এটিই বিএনপির তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যে নতুন করে সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। সর্বশেষ, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাতের পরও নির্বাচনের সময় নিয়ে কোনো স্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি, যা বিএনপি নেতাদের কাছে ‘ধোঁয়াশা’ বলে মনে হচ্ছে।

বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা বলছেন, আগে জুন এবং পরে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হলেও এখন ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলা হচ্ছে, যা তাদের সংশয় আরও বাড়াচ্ছে।

‘সরকারের মধ্যেই দোটানা’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক মনে করেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন করার ব্যাপারে সরকারের মধ্যে এক ধরনের দোলাচল বা দোটানা রয়েছে, যে কারণে পরিস্থিতিকে ধোঁয়াশা রাখা হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, সরকার বিভিন্ন পক্ষকে এক জায়গায় আনতে ব্যর্থ হয়েছে এবং মাঠ পর্যায়ে প্রশাসনকে এখনো শক্তভাবে দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি, ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।

অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর নির্বাচন পদ্ধতি এবং স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবি—এসব ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু সামনে আসায় ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিভক্ত দলগুলো

জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস এবং গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি ইসলামপন্থী দল আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের নির্বাচনি ব্যবস্থার দাবি তুলেছে। তাদের যুক্তি হলো, এই পদ্ধতিতে প্রতিটি ভোট কাজে লাগে এবং সংসদে সমান প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হয়, যা স্বৈরাচারী শাসন প্রতিরোধে সহায়ক। তারা সর্বনিম্ন ১ শতাংশ ভোট পেলেও সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাব করেছে, যা ছোট দলগুলোর জন্য সংসদে প্রবেশের পথ সুগম করবে। বিশ্বের ১৭০টি দেশের মধ্যে ৯১টি দেশে আনুপাতিক নির্বাচনব্যবস্থা প্রচলিত আছে।

তবে বিএনপি ও এর মিত্র দলগুলো এই পদ্ধতির বিরোধিতা করছে। তারা মনে করে, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এই পদ্ধতি এখনই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয় এবং এর জন্য দীর্ঘ প্রস্তুতির প্রয়োজন। তারা সরাসরি ভোটের বিদ্যমান ব্যবস্থার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন।

জোটগত নির্বাচন ও পদ্ধতির প্রশ্ন

বাংলাদেশে জোটগতভাবে নির্বাচন করার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। ছোট দলগুলো বড় দলের জোটে আশ্রয় নিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতিতে জোটগত নির্বাচন কীভাবে কার্যকর হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইসলামপন্থী দলগুলোর নেতারা বলছেন, এসব বিষয় আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা হবে।

উচ্চকক্ষে আনুপাতিক ভোটের প্রস্তাব

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংসদের উচ্চকক্ষে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতির প্রস্তাব করেছে, যদিও নিম্নকক্ষে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা বহাল রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে বিএনপি সংসদের উচ্চকক্ষেও আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের পদ্ধতির ভোট চায় না; তারা নিম্নকক্ষে সরাসরি ভোটে যে দল যতটা আসন পাবে, সেই অনুপাতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টনের পক্ষে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি এবং ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবগুলো চূড়ান্ত হলে সেগুলো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে। তবে তারা নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তা নেই বলে দাবি করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দলগুলোর মধ্যে এই মতপার্থক্যের মীমাংসা সম্ভব না হলে এবং সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব থাকলে নির্বাচন ঘিরে অনিশ্চয়তা আরও বাড়তে পারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top