বাংলাদেশে ভারি বর্ষণ ও উজানের ঢলে ব্যাপক বন্যা: বিপর্যস্ত জনজীবন, সতর্কতা জারি

মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় সারাদেশে গত কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে উজানের ঢলে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ি ঢল এবং টানা বর্ষণে ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ বেশ কয়েকটি জেলার নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, যার ফলে লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

সর্বশেষ পরিস্থিতি:

আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, আজ (বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, ২০২৫) সকালেও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অধিকাংশ স্থানে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি হচ্ছে। তবে দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোতে বৃষ্টির তীব্রতা বেশি। বিশেষ করে গত ২৪ ঘণ্টায় ফেনী জেলায় রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত (৩০৬ থেকে ৪৪০ মিলিমিটার) রেকর্ড করা হয়েছে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার চিত্র:

  • ফেনী: মুহুরী, কহুঁয়া ও সিলোনিয়া নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৫ থেকে ১৭টি স্থান ভেঙে গেছে, যার ফলে ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলার ৩০টিরও বেশি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। প্রায় ১,২০০ জনের বেশি মানুষ এবং ২০০টির বেশি গবাদিপশু আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরিত হয়েছে। মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
  • কক্সবাজার: গত এক সপ্তাহের টানা বর্ষণে কক্সবাজারের ৮০টির বেশি গ্রাম আকস্মিক বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফ উপজেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যেখানে প্রায় ৪০টি গ্রামের ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। উখিয়া উপজেলাতেও প্রায় ১৬টি গ্রামে আকস্মিক বন্যা দেখা দিয়েছে, যা প্রায় ১০ হাজার মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। উখিয়ার রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরগুলোও (ক্যাম্প ৩, ৭, ১২, ও ২২) বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে, যেখানে প্রায় ১৫ হাজার বাসিন্দা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
  • চট্টগ্রাম: টানা বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নগরীর আগ্রাবাদ, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, বাকলিয়া, ইপিজেড, পতেঙ্গাসহ বিভিন্ন নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। দুঃখজনকভাবে, চট্টগ্রাম নগরীতে নালার পানিতে পড়ে তিন বছর বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য খালাস কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে।
  • ভোলা: উপকূলীয় এই জেলার নিচু এলাকাগুলো প্লাবিত হয়ে শত শত পরিবার দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

নদী পরিস্থিতি ও সতর্কতা:

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, পদ্মা, যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি পেতে পারে। মুহুরী ও সিলোনিয়া নদীর পানি বর্তমানে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় আগামী দিনগুলোতেও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকতে পারে। ভারী বর্ষণের কারণে উপকূলীয় নিচু এলাকায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি এবং পাহাড় ধসের আশঙ্কা রয়েছে।

প্রস্তুতি ও ত্রাণ কার্যক্রম:

জেলা প্রশাসন এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ ও উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলো খোলা রাখা হয়েছে এবং পানিবন্দি মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার কাজ চলছে। মৎস্যজীবীদের পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতে নিষেধ করা হয়েছে এবং নৌযান চলাচলও সীমিত করা হয়েছে।

জনসাধারণকে বর্তমান আবহাওয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক থাকতে এবং যেকোনো জরুরি অবস্থার জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top